সুদের জালে আটকা কক্সবাজারে বিশাল জনগোষ্ঠী

কক্সবাজারে সুদের জালে ছেয়ে গেছে শহরসহ বেশকিছু গ্রামাঞ্চল। সুদের ওপর দেওয়া টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে কয়েকগুন বাড়লেও পরিশোধ হয় না মূল টাকা। আর এই লেনদেনকে কেন্দ্র করে হতাহতের ঘটনা থেকে শুরু করে হচ্ছে পারিবারিক বিচ্ছেদ। সুদের জালে আটকা পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন স্থানীয়রা; এমনকি ভিটেবাড়িও।
সদর উপজেলা খুরুশকুল হামজার ডেইলের পুনর্বাসিত এলাকার মনজুর আলমের স্ত্রী মনজুরা বেগম সপ্তাহে দেড় হাজার টাকা লাভ দেওয়ার চুক্তিতে ৫ হাজার টাকা নেন একই এলাকার রোজিনার কাছ থেকে। ওই টাকা তিনি পরিশোধ করতে না পারায় মূল টাকার সঙ্গে লাভের টাকা যুক্ত করে আবার ওই টাকার উপর লাভ বসিয়ে চক্রবৃদ্ধি হারে এক বছরে ওই টাকা দাড়ায় ৭৬ হাজার টাকা। পরে মনজুরা ক্ষুদ্র ব্যাংক থেকে কিস্তি নিয়ে ৫৬ হাজার টাকা লাভ দেন রোজিনাকে।
এরপরেও থেকে যায় ২০ হাজার টাকা। আরেক জায়গা থেকে মনজুরা ২০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন যেখানে পরে দিতে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার। এ নিয়ে তিনি চরমভাবে মানসিক ও পারিবারিকভাবে চাপে রয়েছেন। বর্তমানে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বসতভিটা বিক্রি করে দেবেন।
একইভাবে সুদের জালে আটকা পড়ে বসত ঘর বিক্রি করেছেন আয়েশা বেগম। গত দেড় বছর আগে দুইজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে স্বামীর জন্য অটোরিকশা নিয়েছিলেন। রিকশা কেনার সেই সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে তাকে বসত ভিটা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বর্তমানে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন মেয়ের বাড়িতে।
শুধু মনজুরা আর আয়েশা নয়। ওই এলাকায় তাদের মতো আরও শত শত নারী সুদের জালে আটকা পড়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। তাদেরকে এক সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে আরেক জায়গা থেকে সুদ নিতে হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে সুযোগ প্রত্যাশী ক্ষুদ্র ব্যাংক ও এনজিও ওয়ালাদের দৌরত্ব। যারা ওই মানুষদেরই লাভের সুদের বিনিময়ে ঋণ দিচ্ছে। এতে তাদের দুই জায়গা লাভ টানতে হচ্ছে।
ওই এলাকায় সুদ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন, রুজিনা, ফারুলীর মা, ছকিনা, সেলিনা, জোহরার মা, শহর বানু, আনোয়ারাসহ অন্তত অর্ধশত নারী। কম টাকায় এত সুদ কিভাবে আসে এই তথ্য উদঘাটনে জানা যায়, সুদ সিন্ডিকেটের তৈরি নিয়মে যে টাকাটা তারা লাভের চুক্তিতে দিচ্ছেন নির্দিষ্ট সময়ে সেই লাভ দিতে না পারলে, ওই লাভের টাকা আসল টাকার সঙ্গে যুক্ত করে ফের লাভের হিসাব করা হয়।
এভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে ৫ হাজার টাকা ৭৬ হাজার এবং ২০ হাজার টাকা ১ লাখ ২০ টাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। আর সুদখোরদের সহযোগিতা নিয়ে টাকা উদ্ধারে সাহায্য করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
আর এমনও তথ্য রয়েছে কিছু নারী মিথ্যা আশ্বাসে গণহারে সুদের বিনিময়ে টাকা নিয়ে নিজেই সুদের ব্যবসা করছে। মনজুরা নামে এমন একজন নারী’র তথ্য পাওয়া গেছে। যিনি অন্তত ১৫ জন থেকে সুদে’র উপর টাকা নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুদ প্রদানকারী এক নারী জানান, পুনর্বাসিত ওই এলাকায় তাদেও জায়গার টোকেন বন্ধক দিয়েই অনেকে সুদের উপর টাকা নেন। পরে ওই টাকা না দিয়ে সৃষ্টি করে নানা ঝামেলা। সমাজকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে সামাজিক সচেতনতার সঙ্গে আইন প্রয়োগের কথা বলছেন সচেতন মহল।
ওই এলাকার নুর মোহাম্মদ নামে এক সচেতন যুবক জানান, এই সুদের টাকার কারণে এলেকায় প্রতিনিয়ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চলছে ঝগড়া। বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে অহরপ। অনেকে ভিটে বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে।
মিজবা উদ্দিন আপেল নামে আরেক যুবক জানান, এলাকার নারীরাই মূলত সুদের জালে আটকা। সুদ সিন্ডিকেট তাদের কাছ থেকে মূল টাকার দুই-তিনগুন পর্যন্ত লাভ আদায় করছে। এই ক্ষেত্রে সমাজিক সচেতনতার সাথে আইন প্রয়োগ জরুরি।
সমাজকর্মী মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম জানান, হারাম সুদ থেকে একদিনেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে নিজের সচেতনতার পাশাপাশি অন্যদের বুঝিয়ে এই অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হবে।
সুদের ভয়াবহতার প্রসঙ্গে কক্সবাজার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক ফাহমিদা বেগম জানান, সুদের কারবারির মূল টার্গেট নারী। এলাকার সুদ সিন্ডিকেটের সঙ্গে কিছু ক্ষুদ্র ব্যাংক এবং এনজিও রয়েছে যারা এই হারাম কাজের সঙ্গে যুক্ত। কেউ যদি কোনো যুক্তি দেখিয়ে সুদকে বৈধ বলে তা সম্পূর্ণ ভুল এবং অপরাধ। ভুল করেও এইটা হালাল হবে না এইটা হামার উপার্যন। সুদ পারিবারিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি করে। সকল শান্তি বিনষ্টকারীর সুদ ও হারাম উপার্যন। সুদের টাকায় হয়ত ধন-সম্পদ দেখতে পাবে কিন্তু এই হারাম উপার্যনের ফলাফল ভয়াবহ।
সুদকে সম্মিলিতভাবে বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে তিনি সুদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিবাদ গড়ে তুলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন।