নাসিরনগরে ছাত্রদল নেতা খুনের ঘটনায় গ্রামছাড়া ২ শতাধিক পরিবার

৫ জুলাই ২০২৫ দিনটি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের কাঠাল কান্দি গ্রামবাসীর জন্য একটি ভয়ংকর দিন। এ দিন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কাঠালকান্দি গ্রামের সোহরাব (২৫) নামে এক ছাত্রদল নেতা খুন হয়। খুনের জের ধরে একপক্ষের আগুনে জ্বলছে অন্যপক্ষের বাড়িঘর, পশু,গাছপালা ও খড়ের গাদা।বর্তমানে ৫টি বাড়িতে করা হয়েছে অগ্নিসংযোগ, ৩ ডজন বাড়ি ও অর্ধ ডজন দোকানে করা হয়েছে লুটপাট। গ্রামজুড়ে কেবলই নারী ও শিশুদের হাহাকার, লুটপাটের চিহ্ন আর পোড়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপ। প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া আনুমানিক ২ শতাধিক শিক্ষার্থী পরিবার।পুলিশি গ্রেপ্তার আর ভয়-আতঙ্কে গ্রামছাড়া অর্ধেক গ্রামবাসী। জনবল সংকটে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রও আস্থা রাখতে পারছে না জনমনে।
৫ জুলাই শনিবার উপজেলার চাতলপাড় বাজারে মোল্লা গোষ্ঠী ও উল্টা গোষ্ঠীর মধ্যে বংশগত প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিহত হন চাতলপাড় ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক সোহরাব (২৫)। এ ঘটনার জের ধরে ওই দিন বিকেল থেকেই পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে মধ্যযুগীয় উন্মাদনা ও আতঙ্ক। শুরু হয় প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। বাজারে ও চলে দোকানপাঠে ভাংচুর লুটপাট।পুলিশের বাড়তি ফোর্স ও সেনাবাহিনীর অভিযানের পরও কাটেনি এলাকাবাসীর আতঙ্ক।
সরেজমিনে কাঠালকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। গ্রামের রাস্তায় পড়ে আছে ভাঙা দরজা-জানালা, আধা পোড়া টিন, কাঁচের গুড়া। জনশূন্য রঙিন পরিপাটি দালানে পড়ে আছে ভাঙা ফ্রিজ, ভাঙা এসি, ওয়াশিং মেশিন, লণ্ডভণ্ড আসবাবপত্র। কয়েকটি বাড়ির কোথাও কোথাও থেকে তখনও আগুনের ধোঁয়ার গন্ধ বেরুচ্ছিল।দেখে মনে হল যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ।
বৃদ্ধা মমতাজ বেগম বলেন, “আমরা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করিনা। তারপরও আমাদের বাড়িতে মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন হামলা করে সব ভেঙে নিয়ে গেছে। এখন জমিতে ঘুমাই। তিন দিন ধরে খাবারও নেই। বাড়িতে এসে পানি খাব, হামলাকারীরা ঘরের চুলা এমনকি পানির টিউবওয়েলটিও তুলে নিয়ে গেছে।”
সাফিয়া বেগম নামে এক নারী বলেন, “আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায়। কিন্তু মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন আমার ঘরটা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার একটা ছেলে সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে এই ঘরটা তুলেছিল। আজকে আমার সব শেষ।
সখিনা বেগম নামে আরেক বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে সাংবাদিকদের বলেন, “সবকিছু চোখের সামনে পুড়তে দেখলাম। বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। ছেলেরা ভয়ে পালিয়ে গেছে । আমরা কই যাব, কী খাব, কিছুই জানি না।”
অন্তঃসত্ত্বা কুহিনূর বেগম বলেন, “আমায় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গলা থেকে স্বর্ণালংকার লুট করে ঘরে থাকা সবকিছু নিয়ে গেছে। এমনকি আমার ওষুধগুলোও নিয়ে গেছে।
সংঘর্ষ ও প্রাণহানির প্রভাব পড়েছে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য আর শিক্ষাব্যবস্থায়ও। দেখা যায়, কাঠালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২১ শিক্ষার্থী। জানা যায়, আতঙ্কে একজন শিক্ষকও ছুটি নিয়ে আছেন আত্মগোপনে। প্রধান শিক্ষক তুহিনা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীরা তো বটেই, শিক্ষকরাও আতঙ্কে আছেন। অভিভাবকদের ফোন করেও সাড়া পাচ্ছি না।
চাতলপাড় বাজারের অন্তত ছয়টি দোকানে করা হয়েছে লুটপাট। এর মধ্যে চালের আড়ত, মোবাইল ও বিকাশের দোকান এবং রড-সিমেন্টের দোকান রয়েছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, দোকানগুলো থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার মালামাল লুট হয়েছে। ব্যবসায়ী হামজা ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলেন, “আমার ২৫ লাখ টাকা ও দোকানের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় চাতলপাড় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মোল্লা গোষ্টির ও মোতাহার মিয়া ও যুবদলের সভাপতি উল্টা গোষ্টির মো. গিয়াস উদ্দিনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত।
উল্টা গোষ্ঠীর নেতা গিয়াস উদ্দিন অভিযোগ করেন, তাদের গোষ্ঠীর অন্তত পাঁচজনের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ৪০টির বেশি বাড়িতে লুটপাট চালানো হয়েছে। হামলা থেকে রক্ষা পায়নি স্থানীয় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও জাসাসের নেতাদের বাড়িঘরও।
চাতলপাড় পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের জনবল কম এবং যাতায়াতের জন্য কোনো সরকারি যানবাহন নেই। ওই এলাকায় যাওয়াও কঠিন। লুটপাটের সময় শত শত লোক টেঁটা-বল্লম নিয়ে নেমে পড়ায় পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, আমরা ঝুঁকি নিয়ে চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না।
মামলা হতে দেরী হচ্ছে কেন? জানতে চাইলে চাতলপাড় তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রাপ্ত আই সি মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান,মামলা প্রক্রিয়াধীন।কোন নিরপরাধী লোক,মারা গেছে ও প্রবাসে আছে এমন লোক যেন আসামী না হয় এ জন্য আমরা তদন্ত করছি।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইসহাক মিয়া জানান, “দ্রুত শিক্ষা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে স্কুলে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “গ্রামের ২টি প্রভাবশালী ও বড় গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের কারণে তৃতীয় কোনো গোষ্ঠী তেমন ভূমিকা রাখতে না পারায় ঘটনা তাৎক্ষণিক ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আমি চেষ্টা করেও সফল হতে পারিনি। চেয়ারম্যান হিসেবে আমি খুবই অনুতপ্ত… ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।”
নাসিরনগর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আজহারুল ইসলাম জানান, “এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি, মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে এলাকা শান্ত রয়েছে।