ঢাকা রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১


যুদ্ধকালীন ডাকাত পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা,ছেলে পুলিশে চাকরি!


১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:১১

আপডেট:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:২০

বাগেরহাটের মোংলার বুড়িরডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মো. দেলোয়ার হোসেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী এ দেলোয়ার এখন ভাতাপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। এরপরও তিনি পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। তার এক সন্তান মুক্তিযোদ্ধার কোটায় পুলিশে চাকরিও পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক যুগ পার হলেও মুক্তিযোদ্ধা সেজে থাকা ‘ডাকাত’ দেলোয়ারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ বাগেরহাট জেলার মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযোদ্ধা না হলেও ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় দেলোয়ার হোসেনের নাম অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে গত বছর ৩০ অক্টোবর বুড়িরডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সুদীপ সরকার মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, যুদ্ধকালীন সুন্দরবনে অবস্থান করে বাগেরহাটের রাধাবল্লবসহ আশপাশ এলাকায় ডাকাতি করতেন মুক্তিযোদ্ধা সেজে থাকা দেলোয়ার হোসেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল প্রকাশিত মুক্তিভাতা তালিকায় বাগেরহাট জেলার কোথাও তার নাম অন্তর্ভুক্ত নেই। অথচ নিজ জন্মস্থান গোপন করে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নানা কূটকৌশলে মোংলায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেন দেলোয়ার। এরপর অর্থ ও কায়িক শক্তি ব্যবহার করে দালালচক্রের মাধ্যমে বেআইনিভাবে মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করান। যার গেজেট নম্বর ২৭৮৪।

জানা যায়, সুদীপ সরকারের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর তা তদন্ত করে জানানোর জন্য বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে মোংলা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নয়ন কুমার রাজবংশী বিষয়টি তদন্ত করেন। এরপর তিনি ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর একটি শুনানি করেন। শুনানিকালে ৩২ জন সাক্ষী ও ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় শতাধিক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তদন্ত ও শুনানি শেষে চলতি বছর ১১ মার্চ জেলা প্রশাসক বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন পাঠান সহকারী কমিশনার (ভূমি) নয়ন কুমার রাজবংশী। জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘মোংলা উপজেলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নিখিল চন্দ্র রায় ও বাগেরহাট জেলা পরিষদের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা শেখ আ. রহমানসহ উপস্থিত সব মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অস্বীকার করেন। উপরন্তু তিনি ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও তারা উল্লেখ করেন। দেলোয়ার দাবি করলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।’

মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি সুযোগ-সুবিধা আদায় আর সন্তানকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার বিষয়ে দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি  বলেন, বাগেরহাটের রাধাবল্লব এলাকার বাসিন্দা তিনি। ১৯৭১ সালে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ এলাকা কচুয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন অন্য সবার সঙ্গে। তার দাবি, তিনি ওই এলাকার তৎকালীন ট্রেনিং কমান্ডার আমির আলী শেখ এবং কচুয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গ্রুপ কমান্ডার জিতেন্দ্রনাথ পালের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধার কোটায় এক সন্তানের পুলিশে চাকরি পাওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করেন তিনি। সম্প্রতি মারা গেছেন মুক্তিযোদ্ধা আমির আলী শেখ। তবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গ্রুপ কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা জিতেন্দ্রনাথ পাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১৯৭১ সালে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে তিনিসহ ৬৫ জন কচুয়া এলাকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন দেলোয়ার হোসেন কখনই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।

জিতেন্দ্রনাথ বলেন, ‘যুদ্ধকালীন দেলোয়ার সুন্দরবনের ডাকাত সর্দার নূর ইসলামের সঙ্গে বনে ডাকাতিতে জড়িত ছিলেন। জেলায় বিভিন্ন এলাকায় মানুষের বাড়িঘরে হামলা আর লুটপাট করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর ডাকাত সর্দার নূর ইসলামের মৃত্যুর পর দেলোয়ার তার (নূর ইসলামের) স্ত্রীকে বিয়ে করেন। নানা বিতর্কিত কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকায় দেলোয়ার কখনো তার জন্মস্থান কচুয়া উপজেলায় আসতে পারেননি। মোংলাতে স্থায়ী বসবাস করতে থাকেন। এরপর তিনি ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে কোনো এক সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজে গেছেন। এক সন্তানকে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় পুলিশে চাকরি দিয়েছেন।’

‘প্রতারণার মাধ্যমে দীর্ঘদিন মুক্তিযোদ্ধা সেজে থাকা’ দেলোয়ার হোসেনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ না দেওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা জিতেন্দ্রনাথ পাল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার  বলেন, ‘একটি লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। নিয়মানুযায়ী দ্রত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিষয়টি তদারকি করব।’

এদিকে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী সুদীপ সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার পর থেকে আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকিধমকি দিচ্ছেন দেলোয়ার ও তার সহযোগীরা। ঢাকায় একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় তার এক আত্মীয় কাজ করেন। তাকে দিয়েই বাগেরহাট জেলা প্রশাসককে ম্যানেজ করেছেন আর আমার করা অভিযোগ গায়েব করার কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন দেলোয়ার।’

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘এটি এখন কোন অবস্থায় আছে তা অফিশিয়াল রেকর্ড দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলতে হবে। তবে এ বিষয়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’