গর্জনিয়া–কচ্ছপিয়ার পাহাড়ে সন্ত্রাস দমনে নতুন সম্পর্কের নতুন সমীকরণ: আইসি শোভন কুমারের নেতৃত্বে বদলে যাচ্ছে সীমান্ত জনপদ
কক্সবাজারের রামু উপজেলার দক্ষিণ–পূর্ব প্রান্তে দু’টি সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি ইউনিয়ন—গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই অঞ্চল বহুদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছে আরেকটি বাস্তবতা—সন্ত্রাস, অপহরণ, পাহাড়ি ডাকাতদল এবং মাদকচক্রের ঘাঁটি হয়ে ওঠা এক জনপদ।
সরকারি পরিসংখ্যানে জনসংখ্যা ২৮,৩৩৬ জন হলেও মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রবীণ ও সমাজকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়—এই দুই ইউনিয়নে প্রকৃত জনসংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি। নিবন্ধনের বাইরে থাকা পাহাড়ি পরিবার, অভ্যন্তরীণ অভিবাসন এবং অগণিত বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি বসতির কারণে সরকারি হিসাব বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
এই বিপুল জনসংখ্যার নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব বহন করছে একটিমাত্র পুলিশ ফাঁড়ি—গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ি। আর সেই ফাঁড়ির নেতৃত্বে বর্তমানে আছেন আইসি পুলিশ ইন্সপেক্টর শোভন কুমার। স্থানীয়দের ভাষায়—
“এই পাহাড়ি জনপদের নিরাপত্তা এখন এক ব্যক্তিকে ঘিরেই—আইসি শোভন।”
গভীর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে পাহাড়ি জনপদের অন্ধকার অতীত, পরিবর্তনের নতুন প্রেক্ষাপট এবং পুলিশ–জনতার নতুন Equation।
অতীতের গর্জনিয়া–কচ্ছপিয়া: ভয়, অপহরণ, মাদক আর ‘নীরব রাতের’ গল্প
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় এক দশক ধরে এই জনপদ ছিল অপরাধচক্রে ভর্তি একটি অন্ধকার এলাকা।
পাহাড়ি ছড়ার ভেতর ডাকাত দলের ঘাঁটি ইয়াবা ও আইসের চোরাচালান,রাতে অপহরণ,চাঁদাবাজদের দাপট,পাহাড়ি রুটে অস্ত্র পরিবহন।
এক সময় সন্ধ্যার পর খোলা বাজার দেখা যেত না। রাস্তায় মানুষ চলাচল বন্ধ হয়ে যেত। পাহাড়ের গভীরে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় বিপদে পড়লেও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত না।
এক প্রবীণ কৃষক আমাদের জানান, “রাতে যদি কুকুরের ডাকে পাহাড় কেঁপে উঠত, আমরা বুঝতাম ডাকাত বা সন্ত্রাসীরা নেমেছে। দরজায় তালা দিলেও ভয় কাটত না।”
পাহাড়ি রুটগুলো: ‘মাদকের গোপন মহাসড়ক’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে—গর্জনিয়া–কচ্ছপিয়া শুধুই দুর্গম জনপদ নয়; এ অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে ছিল মাদক চক্রের ‘নিরাপদ রুট’। সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি পথ ব্যবহার করে ইয়াবা ও আইস ঢুকত গভীর জঙ্গলে, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ত জেলা জুড়ে।
এক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি প্রত্যক্ষ করেছেন,
“সন্ধ্যার পর পাহাড় থেকে টর্চলাইটের আলো নামতে দেখলে সবাই বোঝত—কারা যাচ্ছে, কী নিয়ে যাচ্ছে।”
কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায়—এই ভয়াবহ নেটওয়ার্ক ভাঙল কীভাবে?
আইসি শোভন কুমারের নেতৃত্বে ‘তথ্য–নির্ভর অভিযান’: পাহাড় কাঁপানো পরিবর্তন
২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন পুলিশ ইন্সপেক্টর শোভন কুমার। তাঁর আগমনের পরই এলাকা জুড়ে শুরু হয় পুলিশের বাড়তি তৎপরতা।
অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে তাঁর নেতৃত্বে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ— পাহাড়ি রুট ডিজিটাল মানচিত্রে আনা গোপন পাহাড়ি পথ, ছড়ার ভেতরের রুট, চোরাচালানের সম্ভাব্য লুকিয়ে থাকা স্থান—সবকিছু জুড়ে তৈরি করা হয় একটি সমন্বিত ডিজিটাল ম্যাপ। মাদকচক্রে নজরদারি বাড়াতে মোবাইল–ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক,স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে গড়ে তোলা হয় একটি কমিউনিটি–ইনফরমেশন সিস্টেম। এতে সন্দেহজনক চলাচলের তথ্য দ্রুত পৌঁছে যায় পুলিশের হাতে। পাহাড়ি রাতের টহল দ্বিগুণ করা।
মাঠ পর্যায়ে জানা যায়, আগে যেখানে সপ্তাহে দুইবার টহল হতো, এখন প্রতিদিন রাতেই যান পুলিশ সদস্যরা।
ফাঁড়ি এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“রাতে পাহাড়ে যেতে আমরা প্রথা হিসেবে অস্ত্র নিয়ে যাই না; নিয়ে যাই মানুষের আস্থা।”
সন্ত্রাস ও ডাকাতি দমনে বিশেষ অভিযান:অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, একটি বিশেষ অভিযান, যা ছিল ডাকাতদল নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।কয়েকটি পাহাড়ি রাস্তা নিয়ন্ত্রণে এনে সন্ত্রাসীদের রুট কেটে দেওয়া,স্থানীয় পাহাড়ি পরিবারকে নিরাপত্তা চক্রে আনা,চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তার।
এক গ্রামবাসী জানান,
“যারা দাপট দেখাত, আজকে তারা পালিয়ে বেড়ায়। পুলিশের কারণে রাতে ও পাহাড়ে বসবাসরত জনমানব ভয় পাই না"
মাদক দমনে ‘জিরো টলারেন্স’: যুবসমাজে পরিবর্তনের ঢেউ
মাদকবিরোধী অভিযান শুধু গ্রেপ্তারেই সীমাবদ্ধ নয়—এবার যুক্ত হয়েছে গণসচেতনতা ও বিভাগীয় সমন্বয়।স্কুল–কলেজে মাদকবিরোধী বক্তৃতা,ক্রীড়া টুর্নামেন্টে পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতা,যুবসমাজকে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা।
এক কলেজ শিক্ষক জসিম উদ্দিন বলেন,
“যে এলাকায় মাদক ছিল তরুণদের নিত্যসঙ্গী, সেখানে এখন শিক্ষার্থীরা মাদকের বিরুদ্ধে পোস্টার বানাচ্ছে—এটাই পরিবর্তন।”
জনতার পুলিশ–পুলিশের জনতা: এলাকার অভূতপূর্ব আস্থা
গর্জনিয়া–কচ্ছপিয়ার পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে পুলিশ–জনতার অংশীদারিত্ব।
গ্রামভিত্তিক নিরাপত্তা কমিটি:-
আইসি শোভন কুমার নিজেই বলেন,
“অপরাধ দমন শুধু পুলিশের কাজ হলে সমাধান পাওয়া যাবে না। মানুষ সঙ্গে থাকায় আমরা এগোতে পারছি।"
চ্যালেঞ্জ এখনও পাহাড়সম: যোগাযোগ ব্যবস্থায় সংকট
অনুসন্ধানের সময় দেখা যায়—সড়ক ভেঙে গেলে পুলিশ পৌঁছাতে পারে না দ্রুত।
এক টহল দলের সদস্য বলেন,
“আমরা ঝুঁকি নিয়েই যাই। কিন্তু ভাঙা সড়ক আমাদের সীমাবদ্ধ করে।”
যতক্ষণ পর্যন্ত যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত না হবে—অভিযান, উদ্ধার ও নিরাপত্তা–সবই ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
সমাপ্তি: পাহাড়ি জনপদে ফিরে আসছে ‘স্বাভাবিক দিন’
গর্জনিয়া–কচ্ছপিয়া বদলে যাচ্ছে—এ তথ্য মাঠ পরিদর্শনেই উঠে এসেছে স্পষ্টভাবে।সন্ধ্যায় বেলতলি বাজার এখন খোলা থাকে।
অপহরণ–ডাকাতির অভিযোগ কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।পরিবারগুলো আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে
স্থানীয়দের মতে—
“এই পাহাড়ের বাতাস এখন আগের মতো ভয়াবহ নয়; এতে নিরাপত্তার গন্ধ আছে।”
এবং এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছেন—
পুলিশ ইন্সপেক্টর শোভন কুমার,
যার নেতৃত্ব স্থানীয়দের কাছে পাহাড়ি জনপদে নিরাপত্তার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে।
