ঢাকা শুক্রবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৫, ৫ই বৈশাখ ১৪৩২


নেশায় সর্বস্বান্ত লাখো পরিবার


৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:৪৭

আপডেট:
৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:৪৭

রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়ার মহামারি। হাটে-ঘাটে, বাসে-বন্দরে কান পাতলেই শোনা যায়- জুয়া কীভাবে খেলতে হয়, দুই-একদিনে কে কত হরালো, কে কত জিতলো, বাজারে নতুন কোন জুয়ার অ্যাপস এসেছে। এভাবেই মুঠোফোন অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। লোভে পড়েন বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী, তরুণরাসহ স্বল্প আয়ের মানুষ এই জুয়ায় বেশি আসক্ত হচ্ছেন। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছেন তাদের অনেকে। এ কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বল্প বেতনে চাকরিরত বেশিরভাগ মানুষ এসবে ঝুঁকছেন। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় এই জুয়া বিস্তার লাভ করছে। সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ এই জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। তরুণদের অনেকেই কৌত‚হলবশত এই খেলা শুরুর পরেই নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময় খোয়াচ্ছেন হাজার হাজার টাকা।

সহজে বেশি টাকা উপার্জনের লোভনীয় প্রচারণা চালাচ্ছেন ক্রিকেটার সাকিব, নায়িকা বুবলি জান্নাতুল পিয়াসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সেলিব্রেটিরা। এতে আকর্ষিত হয়ে যুব সমাজ ঝুঁকে পড়ছে সর্বনাশা জুয়া খেলায়। এসব অনলাইন ক্যাসিনো অ্যাপস বৈধ বলে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে এসব মডেলদের। যদিও তারা এর দায় অস্বীকার করে বলেন, এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের অবয়ব ব্যবহার করে এ সকল অনৈতিক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পিয়া নিজের মডেলিং জীবনের পাশাপাশি নানা সময় সামাজিক ও আইনি পরামর্শমূলক পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেন। তবে তাকে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে।

গত ১ জানুয়ারি থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ১২টি অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালিয়েছেন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে। শুধু পিয়া নন, শবনম বুবলী, সামিরা খান মাহিও অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন। দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও আছেন এই তালিকায়।

অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্মার্টফোনে নির্ধারিত কয়েকটি অ্যাপস ডাউনলোড করে সেখানে জুয়া খেলা চলে। বিভিন্ন নামের প্রায় ১০ থেকে ১২টির মতো অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি জুয়া খেলা হয়। এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়। জুয়ায় জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, এসব অ্যাপসের বেশিরভাগই পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাংলাদেশে এগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) রয়েছে। রাজধানীর প্রায় এলাকাতেই রয়েছে এই ধরনের এজেন্ট। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ বা প্রদান করে থাকেন। এজেন্টরা বিদেশি অ্যাপস পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে হাজারে কমপক্ষে ৪০ টাকা কমিশন পান। এজেন্টদের মাধ্যমেই বিদেশে টাকা পাচার হয়। আর এতে ব্যবহার করা হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি বিট কয়েন। ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে বিভিন্ন এজেন্টদের বিভিন্ন ব্যাংকের সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট দিয়েও বিদেশে টাকার প্রচার করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী বলেন, প্রথমে ৩৬ টাকা বিনিয়োগ করে ১৬ হাজার টাকা পান তিনি। এতে লোভে পড়ে এই খেলায় মারাত্মক আসক্তি চলে আসে তার। গত ছয় মাসে এই জুয়ার নেশায় পড়ে মোটরসাইকেল বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি পরীক্ষার মধ্যেও তিনি খেলা ছাড়তে পারেননি।

যেভাবে ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করা হয় : অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, এসব খেলা স্বাভাবিক গেমের মতো হওয়ায় প্রকাশ্যে খেলা হলেও আশপাশের মানুষ তা বুঝতে পারেন না। জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বেশিরভাগেরই স্মার্টফোন রয়েছে। যাদের নেই, তারা দিনের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় স্মার্টফোন ভাড়া নিতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম অংশগ্রহণকারীদের জুয়ায় জিতিয়ে লোভে ফেলা হয়। এরপর নেশা ধরে গেলে একের পর এক টাকা খোয়ানোর ঘটনা ঘটতে থাকে। তখন আর বের হওয়ার পথ থাকে না।

রাজধানীর আরেক শিক্ষার্থী জানান, বন্ধুদের জুয়া খেলতে দেখে প্রাইভেট পড়ার ৫০০ টাকা শিক্ষককে না দিয়ে তা দিয়ে খেলা শুরু করেছিলেন তিনি। শুরুর দিকে ভালো লাভ হতে থাকে। কিন্তু তারপরেই লোকসানের পাল্লা বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যেই বাসা থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা নিয়ে খেলায় হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত মুঠোফোন বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে। এটি নেশার মতো। খেলা শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে, ততক্ষণ খেলতে ইচ্ছা করে।

অনলাইন জুয়ার কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি: এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, তার ছেলে স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। কিন্তু অনলাইন জুয়ার কারণে পড়ালেখায় মনোযোগ নেই। কৌশলে টাকা নিয়ে এটা খেলে। কোনোভাবেই বিরত রাখা যাচ্ছে না। ছেলের ভবিষ্যৎ অনলাইন জুয়া নষ্ট করে দিচ্ছে।

বারিধারা এলাকার ঝুপড়ি বাসায় বসবাসরত এক নারী বলেন, তার স্বামী অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কলহ দেখা দেয়ার একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের।

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএলের (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) নতুন মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের এই টুর্নামেন্ট চলবে দুই মাসব্যাপী। আইপিএলের এবারের আসরে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার নেই। তবে আইপিএল নিয়ে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা সমানে চলছে বাংলাদেশে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ক্রিকেটের আসর আইপিএল ও বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) চলাকালে তা আরও বেড়ে যায়।

গত ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারির বিপিএলের পাশাপাশি চলমান আইপিএলের সময় একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগলে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে অবাধে। বাংলাদেশের শীর্ষ তারকারা অর্থের বিনিময়ে এসব বিজ্ঞাপনের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব গণমাধ্যমকে বলেন, প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসের (পরিসর) জুয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে যদি অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পায়, তাহলে এই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় আসবেন।

বিটিআরসি ইতোমধ্যে ব্লক করেছে অবৈধ দুই হাজার ৬০০টি জুয়ার সাইট। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকা। ছাত্র-যুব সমাজ থেকে শুরু করে অনেক বয়স্ক, রিটায়ার্ড পারসনরাও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। এসব অনলাইন জুয়ার সাইট রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সাইপ্রাসসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূলত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে মেন্টরের অধীনে ভারত, দুবাই, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম থেকে ক্যাসিনো গেম পরিচালিত হয়। এক মেন্টরের অধীনে কয়েক হাজার প্লেয়ার অংশ নেয়। এসব মেন্টর মূলত অংশগ্রহণকারীদের আস্থা সৃষ্টির জন্য লাইভ স্ট্রিমিং গেম পরিচালনা করে থাকে। এ সুযোগে জুয়ায় বিনিয়োগ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে। ফলে একদিকে যেমন সর্বস্বান্ত হচ্ছে তরুণ সমাজ, অন্যদিকে টাকা বিদেশে পাচার হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।

বিটিআরসি জাতীয় নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ৮ ধারা অনুযায়ী প্রতিনিয়ত অনলাইন বেটিং সাইট বন্ধ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া সাইট পরিচালনার অনুমোদন নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা কোনো সংস্থা থেকে কোনো সাইট বন্ধের জন্য সুপারিশ করলে সেগুলো বাংলাদেশ থেকে ব্লক করে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন বন্ধের জন্য গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবকে অনুরোধ করা হচ্ছে। তারপরও অনলাইন জুয়া খেলা বন্ধ হচ্ছে না।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে সিআইডি অনলাইন জুয়া বা বেটিং সাইটের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি করছে। সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট শাখার কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, জুয়ার বিভিন্ন সাইটে দেশ থেকে অন্তত ১২ লাখ নিবন্ধন রয়েছে। এরই মধ্যে ৪ থেকে ৫ লাখ আইডিতে নিয়মিত জুয়া খেলা হয়ে থাকে। এসব আইডি থেকে সপ্তাহে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, জুয়া আসক্তদের ফেরাতে প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ। জুয়ার সাইটগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য কঠোর অবস্থান নিতে হবে সরকারকে। পরিবারে থাকা কম্পিউটার-মোবাইল ফিল্টারিং করতে হবে। বাবা-মায়ের খেয়াল রাখতে হবে, সন্তান কী করছে। আর আসক্তদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন না করে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক জীবনে। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত শিশুদের চিকিৎসা নেয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের এই মানসিক অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে বাবা-মা ছুটছেন চিকিৎসকদের কাছে, অনেকেই সুফলও পাচ্ছেন। সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা।