ঢাকা মঙ্গলবার, ২১শে জানুয়ারী ২০২৫, ৯ই মাঘ ১৪৩১


প্রত্নস্থল ও প্রত্নসম্পদ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক


৮ জানুয়ারী ২০২৫ ০০:০১

আপডেট:
২১ জানুয়ারী ২০২৫ ২৩:৪৩

প্রত্নতত্ত্ব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। আমরা ফিরে যাই সুদূর অতীতকালের সংস্কৃতির সারবত্তায়। পুরোনো দিনের মানুষের তৈরি সকল বস্তু ও নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় প্রত্ন অনুসন্ধানের মাধ্যমে। লিখিত তথ্যের মাধ্যমে খুব বেশি হলে পাঁচ থেকে সাত হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব। বর্তমান আবিস্কৃত উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন থেকে কুড়ি থেকে তিরিশ লাখ বছর আগের মানুষের ইতিহাস জানা সম্ভব হচ্ছে। ফলে ইতিহাসে নতুন মাত্রা সংযোজিত হচ্ছে প্রত্নতত্ত্বের মাধ্যমে। প্রত্নতাত্তিকি অনুসন্ধান ও আবিস্কারের মাধ্যমে যেমন পাওয়া সম্ভব অতীত সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের সন্ধান, তেমনই প্রত্নতত্ত্ব জনজীবনের ইতিহাসকে দিয়েছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। কোনো অঞ্চল এবং সে অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে মানুষের আগমন, তাদের সামাজিক জীবন এবং অতীত ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণা ও সমস্যা আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে জানতে পাই। খ্রিষ্টীয় জন্মের বহু আগে থেকেই রাজা-বাদশাসহ নানা শ্রেণির মানুষের মধ্যে পুরাকীর্তির প্রতি আগ্রহ ছিল বলে জানা যায়। সে সময়ের মানুষ তাদের পূর্বপুরুষদের নানা কর্মকাণ্ড নির্মাণকাজ ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সচেষ্ট ছিলেন।

একটি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে প্রাচীন পুরাকীর্তি ও প্রত্নসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মসজিদ-মন্দির-প্রাসাদসহ বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন থেকেছে। এটা খুবই পীড়াদায়ক। এই নির্লিপ্ততা চলতে থাকলে অযত্ন -অবহেলা আর দখল-দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে কালের সাক্ষী আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক স্থাপনাগুলো। বাঙালীর ইতিহাস লেখার জন্য যথোপযুক্ত উপকরণের বড়ই অভাব। এই জল-কাদা, মারী-মড়ক-মন্বন্তরের দেশে ঝড়ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প, বৃষ্টি-বাদল, বন্যা, নদ-নদীর একূল ভাঙ্গা ওকূল গড়ার দেশে ইতিহাসের সপক্ষে পাথুরে প্রমাণ বেশিদিন টেকসই হয় না। মহাকালের গহ্বরে প্রায়ই হারিয়ে যায় অথবা চাপা পড়ে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গাগড়ার খেলায়। সময়ের আবর্তে শাসক আসে, শাসক যায়। নতুন শাসক ক্ষমতার মসনদে বসে লিখতে চায় নিজের মনমতো ইতিহাস। পুরনো শাসকদের ছুড়ে ফেলতে চায় আঁস্তাকুড়ে, ভেঙ্গে ফেলে পুরনো পুরাকীর্তি, গড়ে তোলে নিজের স্থাপনা। অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন সময় নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পুরাকীর্তিগুলো। অথচ যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ইতোমধ্যে আমাদের দেশের অনেক পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। এখনও যেগুলো আছে সেগুলোও বিলীন হওয়ার পথে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনে কোন স্থাপনা ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ বা সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি । বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই বিষয়ে কাজ শুরু করেছে তাদের কাজের পরিধি আরো বৃদ্ধি করলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গুলো সম্পূর্ন ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে। সারাদেশের আনাচে-কানাচে যেসব ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পুরাকীর্তি এখনও আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাচীন স্থাপনাগুলো আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক। আমাদের অতীত গৌরবের সাক্ষী। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। এর জন্য উদ্যোগী হতে হবে সরকারকেই। সারাদেশের গ্রামেগঞ্জে যেসব প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে এগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে ঐতিহ্য নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে সংরক্ষিত বা সংরক্ষণযোগ্য নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত স্থাপনাগুলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অবহেলা-ঔদাসীন্যে ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হওয়া শুধু দুঃখজনকই নয়, জাতি হিসেবে আমাদের জন্য চরম অগৌরবজনকও। কিন্তু গভীর উদ্বেগের বিষয়, আমাদের দেশের অনেক মূল্যবান পুরাকীর্তি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে অন্য দেশে পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশের পুরাকীর্তির পাচার রোধ এবং এগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ঐতিহাসিক স্থাপনার পরিচর্যার পাশাপাশি প্রাপ্ত পুরাকীর্তি সংরক্ষণে উদ্যোগ নিতে হবে। সেসব নিদর্শন থেকে নতুন প্রজন্ম অতীত ইতিহাসকে জানতে পারবে এবং নতুন গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি হবে।

 

সাকিব হাসান

শিক্ষার্থী,

ইতিহাস বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 


প্রত্নতত্ত্ব, ঢাবি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, History Archeology