ঢাকা শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১


অনুমোদন ছাড়াই চলছিল হাশেম ফুডের কারখানা


১১ জুলাই ২০২১ ০৭:৪১

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ১৬:৫০

প্রচলিত আইন অনুযায়ী কোনো ভবন তৈরিতে বিল্ডিং কোড মানা বাধ্যতামূলক। সেই ভবনে কারখানা চালাতে গেলে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের অনুমোদন নিতে হয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স থেকে। রাসায়নিকের গুদাম করতেও লাগে বিশেষ অনুমোদন। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে নিতে হয় আরও কিছু বিষয়ে ছাড়পত্র। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানাটি কোনো নিয়মই মানেনি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোও ছিল নিশ্চুপ। দুদিন ধরে জ্বলে-পুড়ে ৫২ শ্রমিকের প্রাণ কেড়ে ভয়াবহ আগুন নেভার পর এখন বিষয়গুলো নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এত বড় একটি কারখানা প্রশাসনের নাকের ডগায় কীভাবে চলছিল উঠেছে সেই প্রশ্নও।

এদিকে, হাশেম ফুডের মূল প্রতিষ্ঠান সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইওসহ আটজনকে গতকাল শনিবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আদালত তাদের ৪ দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন। গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেন, তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্তের পরই বলা যাবে কার দোষ কতটুকু। তদন্তে নির্মাণত্রুটি, শ্রমিক পরিচালনায় ত্রুটি বা কেউ যদি সামান্য ভুলও করে থাকেন তবে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। শিশুশ্রম বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, তদন্তে সেটি বেরিয়ে এলে অবশ্যই বিচার হবে। আহত ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

রূপগঞ্জের কর্ণগোপে হাশেম ফুডের ওই কারখানা ও গুদাম ভবনে বৃহস্পতিবার বিকালে আগুন লাগে। শুক্রবার দুপুরের পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ধোঁয়া উড়ছিল বিভিন্ন স্থান থেকে। প্রায় ৪৫ ঘণ্টার অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযান শেষে গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে স্থানীয় থানা পুলিশের কাছে ভবনটি হস্তান্তর করা হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রতিটি কারখানার ভবনের জন্য ফায়ার সেফটি প্ল্যানের একটি অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ওই কারখানার ভবনটিতে এমন কোনো অনুমোদন ছিল না। রাজউকের ছাড়পত্র, কারখানা অনুমোদনের ছাড়পত্র, পরিবেশের ছাড়পত্র রয়েছে কিনা, সে বিষয়ে অবগত নন তারা।

তবে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানেরও আপডেট অনুমোদন ছিল না হাশেম ফুড কারখানা ভবনটির। এতদিন সবাইকে ম্যানেজ করেই অনুমোদন ছাড়াই ভবনটিতে কারখানা ও গুদাম পরিচালনা করা হচ্ছিল। সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কয়েক মাস পর পর সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তারা ছিল নিশ্চুপ। অগ্নিকা-ের পর কারখানাটিতে ত্রুটিপূর্ণ অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা, জরুরি নির্গমন পথে তালা লাগিয়ে রাখা এবং শিশুশ্রমের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।

গতকাল দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স গঠিত তদন্ত কমিটর প্রধান জিল্লুর রহমান বলেন, অগ্নিকা-ের ঘটনায় ভবনটির পঞ্চম তলার ছাদের মধ্যে ১৫ ফুটের মতো ধসে পড়ে। ভবনটিতে কোনো বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এ কারণে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া কারখানা চালাতে যে সব নিয়ম মানতে হবে তারও বেশকিছু ব্যত্যয় মিলেছে। যা তদন্ত রিপোর্টে বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে।

হাশেমসহ ৮ জন রিমান্ডে

সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাশেমসহ ৮ জনকে চার দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত। গতকাল বিকালে পুলিশ তাদের নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খানমের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত থেকে বের হওয়ার পর আবুল হাশেম সাংবাদিকদের বলেন, মামলা হয়েছে, সেখানেই সব হবে। এখানে আমার কোনো বক্তব্য নেই।

রিমান্ডে যাওয়া অন্যরা হলেন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যানের ৪ ছেলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হাসিব বিন হাশেম, তারেক ইব্রাহিম, তাওসীব ইব্রাহিম, তানজিম ইব্রাহিম এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেনশাহ আজাদ, উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গতকাল দুপুরেই রূপগঞ্জ থানাধীন ভুলতা ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক নাজির উদ্দিন মজুমদার বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এতে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা ও ৩০২সহ কয়েকটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ১৫-২০ জনকে।

ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে

আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে তা গতকাল পর্যন্ত জানতে পারেনি অগ্নিকা-ের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস এবং শ্রম অধিদপ্তরের পৃথক ৩ কমিটি। তবে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভের এক সপ্তাহের মাথায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিষয়টি অনুসন্ধানে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম।

গতকাল সকাল ৭টা থেকে বিকাল পর্যন্ত ভবনটির পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় উদ্ধার অভিযান চালান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে আর কোনো মরদেহ পাননি তারা। বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে অভিযানের সমাপ্তি টেনে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ভবনটির পাঁচ তলার ছাদ জায়গায় জায়গায় ধসে পড়েছে। ভবনটি এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঘটনার দিন ৫২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয় বলেও জানান তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন জানান, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। তদন্ত কমিটি এটা বের করবে। তার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।

স্বজনদের ভিড় কারখানার সামনে

অগ্নিকা-ের পর নিখোঁজ কর্মীদের সন্ধানে স্বজনরা গতকালও ভিড় করেছেন কারখানার সামনে। পুলিশ সদস্য বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মী যাকেই পেয়েছেন প্রিয়জনের ছবি দেখিয়ে তারা অশ্রুশিক্ত চোখে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হ্যাঁরে দেখছেন?’ গতকাল একই পরিস্থিতি ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গেও। সেখানেও ভিড় করেছেন নিখোঁজ ও মৃত শ্রমিকদের স্বজনরা। তবে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করে লাশ বুঝিয়ে দিতে অন্তত তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সিআইডি ডিএনএ ল্যাবরেটরির পরীক্ষক মাসুদ রাব্বি গতকাল সকালে জানান, নিহত ৩৯ জনের স্বজন থেকে নমুনা নেওয়া হয়েছে।

যথাযথ তদন্ত দাবি যুক্তরাষ্ট্রের

ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ৫২ জনের মৃত্যুকে ‘মর্মস্পর্শী’ ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবার। এক টুইট বার্তায় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের অধীন ওই ব্যুরোর তরফে বলা হয়Ñ ফটক তালাবদ্ধ থাকায় অনেক শ্রমিক দরজার ভেতরে আটকা পড়েছিলেন, ফলে অগ্নিকা-ের ঘটনাটি এতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশ তথা বিশ্বব্যাপী সব নিয়োগকর্তাকেই তাদের কর্মীদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা গুরু দায়িত্ব।

এ ছাড়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইস পৃথক টুইট বার্তায় আশা প্রকাশ করেন, মারাত্মক ওই অগ্নিকা-ের ঘটনার এমন তদন্ত হবে যাতে এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা ছাড়াও দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা যায়।