ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


নাটোরের লালপুরের

ইমো হ্যাক করেই দিনমজুর মাসুদ কোটিপতি!


১৩ জুন ২০২১ ২০:৫৭

আপডেট:
১৩ জুন ২০২১ ২২:০৬

গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ইতালি প্রবাসী রেজুয়ান কবির শাকিবের ইমো নম্বর হ্যাক করে একটি প্রতারক চক্র। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে দেশে থাকা রেজুয়ানের মা মাবিয়া খাতুনের ইমো নম্বরে ছেলের ইমো নম্বর থেকে একটি মেসেজ আসে। যাতে জানানো হয় যে রেজুয়ান ইতালি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার মুক্তির জন্য তাৎক্ষণিক দেড় লাখ টাকা দিতে হবে। টাকা পাঠানোর জন্য আলাদা পাঁচটি বিকাশ নম্বরও দেওয়া হয় রেজুয়ানের ইমো নম্বর থেকে। এ খবর শোনার পর রেজুয়ানের বাবা মুনসুর রহমান ছেলের মোবাইল ফোন নম্বরে বারবার কল করেও তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করতে পারেননি। পরে ছেলের মুক্তির জন্য মেসেজের মাধ্যমে পাওয়া পাঁচটি বিকাশ নম্বরে এক ঘণ্টার মধ্যে দেড় লাখ টাকা পাঠান। পরে ওই দিন দুপুর ২টার দিকে রেজুয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার পরিবারের। এ সময় তারা জানতে পারেন রেজুয়ানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি, তারা একটি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছিলেন।

ওই ঘটনার পর ২৯ ডিসেম্বর রেজুয়ানের বাবা মুনসুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর কাফরুল থানায় অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে এক সুইজারল্যন্ড প্রবাসীর ইমো নম্বর হ্যাক করে একইভাবে তার স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় একই চক্র। ওই সুইজারল্যান্ড প্রবাসীর স্বজনরা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের কাছে প্রতারণার শিকার হওয়ার তথ্য জানিয়ে অভিযোগ করেন। আর শুধু রেজুয়ান বা ওই সুইজারল্যান্ড প্রবাসীই নন, একইভাবে আরও অনেকেরই ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ইমো নম্বর হ্যাক করে কৌশলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক চক্র। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এই চক্রের মূল টার্গেট প্রবাসীরা। কারণ দেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে সাধারণ ও ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগের জন্য প্রবাসীরা সব থেকে বেশি ব্যবহার করেন ইমো নম্বর। সেই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে প্রতারক চক্রগুলো।

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, প্রতারক চক্রগুলো বিভিন্ন নামে ইমো গ্রুপ খুলে সেখানে সাধারণ মানুষের ইমো নম্বর সংযুক্ত করছেন। পরে কৌশলে নির্দিষ্ট ইমো নম্বর হ্যাক করে তাৎক্ষণিক তাদের নিকটাত্মীয়কে (মা, বাবা) মেসেজ পাঠিয়ে বলছে, আপনার ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে। আবার কখনো বলছে, পুলিশে ধরেছে। তাকে ছাড়াতে টাকা লাগবে। তবে এসব প্রতারক চক্রের মূল টার্গেট প্রবাসীরা। দেশে থাকা প্রবাসীর স্বজনদের ইমো নম্বর থেকেই কল ও মেসেজ করে বিভিন্ন উপায়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রগুলো। টাকা পাঠানোর জন্য স্বজনদের দেওয়া হচ্ছে বিকাশ নম্বর। আপনজনের বিপদের কথা শুনে স্বজনরাও তড়িঘড়ি করে ওইসব বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে টাকা আত্মসাৎ করে একটি চক্রের অনেক সদস্য ইতিমধ্যে দিনমজুর বা রিকশাচালক থেকে লাখোপতিও হয়েছেন। এমনই এক চক্রের সন্ধান পেয়েছে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম গত ৮ জুন মধ্যরাতে নাটোরের লালপুর থেকে একটি প্রতারক চক্রের হোতা মো. মাসুদ রানাকে (২৭) গ্রেপ্তার করে। ডিএমপি’র কাফরুল থানায় মুনসুর রহমান নামে এক ব্যক্তির করা এক মামলার তদন্তে নেমে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এই মাসুদ রানাই ইতালি প্রবাসী রেজুয়ানের স্বজনদের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

মাসুদ রানাকে গ্রেপ্তারের অভিযানে অংশ নেওয়া ডিবির কর্মকর্তারা জানান, একসময় রিকশা চালাতেন মাসুদ রানা। কিছুদিন দিনমজুরের কাজও করেছেন। অন্য একটি চক্রের কাছ থেকে তিনি ইমো নম্বর হ্যাক করে টাকা আত্মসাতের পদ্ধতি রপ্ত করেছেন। গত দুই বছর ধরে তার একমাত্র পেশা ইমো নম্বর হ্যাক করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করা। এখন পর্যন্ত কয়েকশ মানুষের সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করেছেন তিনি। অল্প দিনেই অঢেল সম্পদের মালিকও হয়েছেন। নাটোরের লালপুরের বাড়িতে এক সময় খড়ের ঘর আর পাটকাঠির বেড়া ছিল। এখন সেখানে গড়েছেন অট্টালিকা। গ্রামের লোকজনও মাসুদের এমন ফুলেফেঁপে কলাগাছ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চক্রটি যে সব বিকাশ নম্বরে টাকা নিচ্ছেন সেগুলো জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা। যাদের নামে ওইসব সিম রেজিস্ট্রেশন করা তারা এর কিছুই জানেন না। ফলে সহজে চক্রগুলোকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সহায়তা নেওয়া লাগছে।

যেভাবে হ্যাক হচ্ছে ইমো নম্বর : ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রতারক চক্র প্রথমে গ্রুপ চ্যাটের জন্য বিভিন্ন নামে ইমো গ্রুপ খুলছে। এরপর ওই গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করছে অন্য ইমো নম্বর ব্যবহারকারীদের। এদের মূল টার্গেটে থাকছে বিদেশি নম্বর দিয়ে খোলা ইমো নম্বর। প্রতারক চক্রের খোলা গ্রুপ থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ইমো নম্বর ব্যবহারকারীকে কল ও মেসেজ করা হচ্ছে। ব্যবহারকারী এতে চরম বিরক্ত হন। ব্যবহারকারীর ওই ইমো নম্বরটি হ্যাক করার জন্য অন্য মোবাইলে চেষ্টা করে চক্রটি। তখন ইমো ব্যবহারকারীর নম্বরে মেসেজের মাধ্যমে একটি ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) যায়। এ সময় ইমো চ্যাট গ্রুপের অ্যাডমিন পরিচয় দিয়ে ওই ইমো ব্যবহারকারীর নম্বরে মেসেজ পাঠিয়ে বলা হয় অযাচিত কল ও মেসেজ থেকে মুক্তি পেতে হলে আপনার ফোনে যাওয়া এসএমএস থেকে ওটিপি নম্বরটি এই নম্বরে পাঠান। যখনই কেউ ওটিপি পাঠান সঙ্গে সঙ্গে হ্যাক হয়ে যায় তার ইমো নম্বরটি। এরপরই বিভিন্ন কৌশলে তার স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা।

এ প্রসঙ্গে ডিবির অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল হক  বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের কাছে অভিযোগ আসছিল একটি চক্র ইমো নম্বর হ্যাক করে নানা কৌশলে টাকা আত্মসাৎ করছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত শুরু করি এবং একটি চক্রের সন্ধান পাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইমো নম্বর হ্যাক করা চক্রগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের টার্গেট করছে। এসব প্রবাসী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইমো ব্যবহার করে থাকেন এবং এরা প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব একটা সচেতন থাকেন না। ফলে সহজেই এদের বোকা বানিয়ে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা।’