ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


পরীক্ষা ছাড়াই টাকায় মেলে করোনা নেগেটিভ সনদ!


১১ জুন ২০২১ ১৭:৪০

আপডেট:
১২ জুন ২০২১ ০৬:০৫

বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষা করার অনুমতি পেয়েছিল রাজধানীর বাংলা মোটরে অবস্থিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘স্টিমজ হেলথ কেয়ার’। গত মঙ্গলবার এ প্রতিষ্ঠানটির হয়ে কাজ করা এক মধ্যস্বত্বভোগীর (দালাল) হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এ প্রতিবেদক তার মোবাইল ফোন নম্বর, পাসপোর্টের দুই পাতার ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ছায়ালিপি পাঠান। এরপর নির্দিষ্ট নম্বরে বিকাশের মাধ্যমে পাঠানো হয় ৬ হাজার টাকা। ওইদিনই রাত ৯টা ৪৪ মিনিটে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে জানানো হয় তিনি ‘করোনা নেগেটিভ’। এর কিছুক্ষণ পর সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া কিউআর কোডসহ করোনা নেগেটিভের সনদও চলে আসে, যেখানে দেখা যায় ‘স্টিমজ হেলথ কেয়ার’ থেকে করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। কিউআর কোডে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ধরার পর স্বাস্থ্য অধিপ্তরের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায় করোনাভাইরাসমুক্ত একই সনদ। অথচ এ প্রতিবেদক স্টিমজ হেলথ কেয়ার বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কখনো করোনা পরীক্ষার জন্য কোনো নমুনাই জমা দেননি। করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ দেওয়ার চক্র চিহ্নিত করতে এ প্রতিবেদক নিজেই বিদেশগামী সেজে কথিত করোনা পরীক্ষার জন্য অর্থ দেন।

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও গতকাল বৃহস্পতিবার করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর চারটি বেসরকারি পরীক্ষাগার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। এগুলো হলো বাংলা মোটরের স্টিমজ হেলথ কেয়ার, বিজয় সরণির সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার, পুরানা পল্টনের আল জামী ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেডের মিরপুর শাখা। নমুনা পরীক্ষা না করেই করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে শাস্তিমূলক এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা।

তিনি গতকাল বলেন, ‘ভুয়া করোনা সনদ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়ার পর চারটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পাওয়া অন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৬ হাজার টাকায় কভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস শনাক্ত পরীক্ষার ভুয়া নেগেটিভ সনদ নিতে প্রয়োজন হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও একটি সচল মোবাইল ফোন সংযোগ। অবশ্য এসব পাঠানোর আগে নির্দিষ্ট একটি বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠাতে হয়। এরপর ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যে মিলছে ভুয়া সনদ। প্রথমে ভুয়া সনদ পেতে আগ্রহী ব্যক্তির মোবাইল ফোনে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে একটি এসএমএস আসছে, তারপর কথিত সনদ পাওয়া যাচ্ছে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। টাকার বিনিময়ে নমুনা জমা না দিয়েই করোনা পরীক্ষার ভুয়া নেগেটিভ সনদ সরবরাহ চক্রের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর এ প্রতিবেদক তা খতিয়ে দেখতে নিজের নামেই ভুয়া সনদ নিয়েছেন একটি চক্রের কাছ থেকে। ওই চক্রটির কাছ থেকে নেওয়া ভুয়া সনদটির সব তথ্যই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও রয়েছে। যদিও ইতিমধ্যে সরকার এ প্রতিবেদককে ভুয়া সনদ দেওয়া স্টিমজ হেলথ কেয়ারসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের করোনার পরীক্ষার অনুমতি সাময়িকভাবে বাতিল করেছে।

বিদেশগামী ব্যক্তিদের করোনাভাইরাসমুক্ত সনদ বা নেগেটিভ সনদ নিতে হয়। করোনা পজিটিভ ব্যক্তির দেশ ছাড়ার সুযোগ নেই। এছাড়া কেউ কেউ করোনা পরীক্ষার ঝক্কিঝামেলায় যেতে চান না। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই টাকার বিনিময়ে নিতে চান ভুয়া সনদ। আর এরই সুযোগ নিয়েছে অনুমতি বাতিল হওয়া দেশের চারটি ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষই ভুয়া সনদ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে।

গত বছর মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর বিদেশে কর্মরত অন্তত দেড় লাখ প্রবাসী দেশে এসে আটকা পড়েন। এসব প্রবাসীর নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরার জন্য করোনাভাইরাসমুক্ত সনদ বাধ্যতামূলক করে দেয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশ। সরকার গত বছর জুলাইতে বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় জেলা সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটের অস্থায়ী কভিড-১৯ আইসোলেশন সেন্টারটি নির্ধারণ করে দেয়। অবশ্য এরপর নমুনা পরীক্ষার জন্য কয়েকটি সরকারি হাসপাতালকেও অনুমতি দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও পরীক্ষাগারকেও নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেয় সরকার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করা হয় ৩ হাজার টাকা।

যেভাবে দেওয়া হতো ভুয়া সনদ : কথিত করোনা পরীক্ষার জন্য রাজধানীর বাংলা মোটরের ‘স্টিমজ হেলথ কেয়ার’-এর হয়ে কাজ করা এক দালালের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে গত মঙ্গলবার এ প্রতিবেদক তার মোবাইল ফোন নম্বর, পাসপোর্টের দুই পাতার ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ছায়ালিপি পাঠান। এরপর নির্দিষ্ট নম্বরে বিকাশের মাধ্যমে পাঠানো হয় ৬ হাজার টাকা। ওইদিনই রাত ৯টা ৪৪ মিনিটে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে জানানো হয় তিনি ‘করোনা নেগেটিভ’। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া করোনাভাইরাসমুক্ত ওই সনদটি সরকারের ওয়েবসাইটেও মিলেছে। সেখানে এ প্রতিবেদকের নিজের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, গ্রামের বাড়িসহ পাসপোর্টে থাকা সব তথ্য হাজির। আপাতদৃষ্টিতে কারও বোঝার কোনো সুযোগই নেই যে, এ প্রতিবেদক আদৌ করোনা পরীক্ষার জন্য কোনো নমুনাই জমা দেননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার এ ভুয়া নেগেটিভ সনদ নিয়ে এখন অনায়াসে বিদেশে ভ্রমণ করা যাবে।

এর আগে গত বছর পরীক্ষা না করিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী। ওই ঘটনায় তারা দুজনসহ আটজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিচার চলছে। তারা কারাগারে রয়েছেন। সমসাময়িক সময়ে টাকার বিনিময়ে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারও বিচার চলছে, তিনি কারাগারে রয়েছেন।দেশরুপান্তর