দলীয় সমর্থনে জিতে এসেছেন বিতর্কিতরাও

গতবারের ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর-দক্ষিণের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে বহু অন্যায়ে জড়িয়ে যান। সরকারের শুদ্ধি অভিযানে চাপেও পড়েন তাদের অনেকেই।
কেউ দেশ থেকে সাময়িক পালিয়ে যান, কেউ আবার দেশে থাকলেও গা ঢাকা দেন। শুদ্ধি অভিযানও জনপ্রিয় হতে শুরু করে। পাশাপাশি কাউন্সিলরদের অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেন।
ফলে আরও বেশি চাপে পড়েন তারা। তবে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিতর্কিত সেসব কাউন্সিলর আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। ঢাকা সিটির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন আদায় করতে তারা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের লেনদেন ও সর্বোচ্চ তদবিরে নামেন।
ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর-দক্ষিণে বেশকিছু কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের সমর্থনও পেয়ে যান।
ফলে সহজেই বিজয়ী হয়ে যান তাদের অনেকেই। গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রায় একডজন বিতর্কিত কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে বিজয়ী হয়ে এসেছেন।
তারা হলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় রয়েছেন ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিসুর রহমান, ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাস, ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন, ৫১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান (হাবু), ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসির) কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জামাল মোস্তফা, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আবদুর রউফ নান্নু, ফরিদুর রহমান খান ইরান নম্বর ওয়ার্ডে ( ৬) তাজুল ইসলাম বাপ্পি, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেন বাবুল, ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফোরকান হোসেন, । এদের বিরুদ্ধে দখল, লুটপাট, মাদক কারবারি ও হত্যাকা-ের মতো জঘন্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় জনগণের দাবি, বিতর্কিতদের সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও তাদের ক্ষমতাধর বানিয়েছে।
যেসব ওয়ার্ডে তারা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন ওইসব ওয়ার্ডেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা অনেকেই আতঙ্কের কথা জানান। স্থানীয়রা বলেন, আওয়ামী লীগের সমর্থনই বিজয়ী করেছে বিতর্কিত কাউন্সিলরদের। সুযোগ ছিল তাদের বাদ দেওয়ার। কিন্তু তা না করে তাদের আবার ক্ষমতাশালী করা হয়েছে।
স্থানীয় জনগণের দাবি, বিতর্কিতদের মনোনয়ন দেওয়াও ভোট কম পড়ার একটি অন্যতম কারণ। বিতর্কিত কাউন্সিলররা মনোনয়ন পাওয়ায় অনেক ওয়ার্ডে নৌকার নেতাকর্মীরা যেমন ভোট দিতে যাননি, তেমনি নিজ নিজ ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষও ভোটকেন্দ্রমুখী হননি। এক ধরনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য বলেন, বিতর্কিত কাউন্সিলরদের বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। কিন্তু দলের অভ্যন্তরের অনেক প্রভাবশালী নেতা বিতর্কিতদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সম্ভব হয়ে ওঠেনি সেটি। তবে তারা কড়া নজরদারিতে থাকবেন বলে জানান ওই নেতা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের অন্য এক সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ কে বলেন, যাদের বিতর্কিত বলা হয় তারা তো জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থন দিলেও জনগণ তাদের তো প্রত্যাখ্যান করেনি। জনগণের বিচারে তারা জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য নিশ্চয়ই। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কাউন্সিলরদের বিষয়টি বেশ আলোচিত।
তবে যতক্ষণ পর্যন্ত বিতর্কিত কাউন্সিলরদের অপরাধ প্রমাণিত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নাই। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের সমর্থন না দিলেও পারত। এটি নৈতিক হয়নি। তারা দলের সমর্থন পেয়েছেন এবং বিজয়ী হয়েছেন। এখন নির্বাচন কমিশনকে খেয়াল রাখতে হবে বিতর্কিতরা বিচারিক প্রক্রিয়ায় অপরাধী প্রমাণিত হলে তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার। তারা যেন বিচার প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে
ফরিদুর রহমান খান ইরান:ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর । রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে ফার্মগেট এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কোচিং বাণিজ্য সবকিছুই তার একক নিয়ন্ত্রণে। তার ক্ষমতার কাছে সবাই ধরাশায়ী। তার ইচ্ছার বাইরে গেলেই চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ। অনেকের মতে ফার্মগেট এলাকার ‘অঘোষিত রাজা’ ইরান। তার কথাই সেখানে আইন, তিনিই সর্বেসর্বা। ফুটপাত থেকে শুরু করে বড় বড় দোকানে চাঁদাবাজি করে তার বাহিনী।তেজগাঁও কলেজেও তার একক আধিপত্য। কাউকেই তোয়াক্কা করেন না। ফার্মগেট এলাকায় যত কোচিং সেন্টার আছে, সবগুলোই ইরানের নিয়ন্ত্রণে। এখান থেকে প্রতি মাসে কামাই লাখ লাখ টাকা।
এভাবে ঢাকার দুই সিটির অর্ধশতাধিক কাউন্সিলর নিজ নিজ এলাকায় একক আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন। নিজ এলাকায় নিজেকে ‘অঘোষিত রাজা’ মনে করেন তারা। তোয়াক্কা করেন না নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও। অনেকেই স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন। অনেক সময় মেয়রকেও তোয়াক্কা করেন না। যেন তারাই সর্বেসর্বা।তারা ও পেয়েছেন দলীয়ও পেয়েছেন দলীয় সমর্থন। জিতেও এসেছেন।
আকাশ কুমার ভৌমিক: ঢাকা দক্ষিণের ৫৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক। কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনি। ১০ বছর আগেও ছিলেন তরকারি বিক্রেতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রীর ছত্রচ্ছায়ায় রাতারাতি বদলে যায় তার জীবনযাত্রা। লেখাপড়া খুব একটা না থাকলেও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে তিনি ছিলেন অন্যতম। এ বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনের নতুন ওয়ার্ডের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হন। এরপর থেকে ভ‚মি দখল, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায় তার দাপট আরো বেড়ে যায়। তার ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ। ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকার প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি করে আকাশ ভৌমিকের ক্যাডার বাহিনী। তার বাহিনীর অন্যতম ছাত্রলীগ নেতা জিহাদ, মুন, ফজুসহ অনেকেই। ফজু ‘ঢাকা মেস’ ও শিল্প এলাকায় প্রতিমাসে কোটি টাকার উপরে চাঁদা কালেকশন করেন আকাশের পক্ষ থেকে। চাঁদাবাজি, মাদক ও টেন্ডারের টাকা দিয়ে রাজধানীর আফতাবনগরে ২০ কাঠা প্লট, বউয়ের নামে ১০ কোটি টাকার এফডিআর, সিদ্বেশ^রীতে দুটি ফ্ল্যাট, এমনকি ভারতেও ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে জানা গেছে। এলাকার কোনো রোড কাটিং করতে গেলেও তাদের কাছে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নেন তিনি। আকাশের ব্যক্তিগত সহকারী ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সভাপতি নাদিম ওয়াসার ভাণ্ডার থেকে শুরু করে স্থানীয় কাজকর্ম তদারক করেন। এ ছাড়া ফুটপাত ও লেগুনা স্ট্যান্ড থেকেও চাঁদাবাজি করেন তার লোকজন।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন : র্যাবের হাতে আটক হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ, জি কে শামীম ও সম্রাটের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকা বিতর্কিত ডিএসসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ডর কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতনও পেয়েছেন দলীয় সমর্থন।এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনও ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থেকে অবৈধ অর্থ আয়ের অভিযোগে তদন্ত চলমান। শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া রতন নগর ভবন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ ভবনে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন।
কাউন্সিলর হয়ে গুলিস্তান এলাকায়ও মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। গুলিস্তানের ফুটপাত ও মুক্তিযোদ্ধা ক্রাড়ী চক্রে ক্যাসিনো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছেন তিনি। নিজস্ব দেহরক্ষী নিয়ে নগর ভবনে প্রভাব বিস্তার করা এ কাউন্সিলর ডিএসসিসির একটি অনুষ্ঠানে দুই কর্মকর্তাকে নিজে উপস্থিত হয়ে মারধর করে বেশ আলোচনায় আসেন। এছাড়া সেগুনবাগিচায় ফুটপাত দখল করে দোকান ও ডিএসসিসির একটি পাঁচতলা ভবনের তিনটি ফ্লোর দখল করে রাখার অভিযোগও এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কাউন্সিলর রতন বলেন, তিনি নিয়ম মেনে বিদ্যুৎ ভবনে ব্যবসা করেন। আর কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ সঠিক নয়।
হাবিবুর রহমান হাবু : ডিএসসিসির ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান হাবুর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। নিজ সংস্থা ডিএসসিসির উচ্ছেদে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এ কাউন্সিলর বরখাস্তও হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে সায়েদাবাদে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদে বাধাদান এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে কাউন্সিলর কাজী হাবিবুর রহমান হাবুকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে পরিবহনে চাঁদাবাজি ও সায়েদাবাদ শ্যামপুর এলাকায় দখলের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
মোহাম্মদ হোসেন : ডিএসসিসির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জমি, খাসজমি, নদীর তীর, খেয়াঘাট, ট্রলারঘাট, রাস্তা, ফুটপাত দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ডিশ-ইন্টারনেটের ব্যবসাও এ কাউন্সিলরের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মাধ্যমে পাওয়া অর্থের বড় অংশ তার। এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা থেকে মাসিকহারে অর্থ নেন হোসেন। এ কাউন্সিলর অল্প দিনের মধ্যেই কামরাঙ্গীরচরের হুজুরপাড়া নূরজাহান স্কুলের সামনে ১০ কাঠা জমিতে বিলাসবহুল বাড়ি, আশ্রাফাবাদ দশআনী বাজারে সাত কাঠা জমি, ইসলামনগর মদিনাবাগ মসজিদের সামনে ছয়তলা বাড়িসহ বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
জামাল মোস্তফা : ডিএনসিসির কাউন্সিলর মো. জামাল মোস্তফা নিজে সরসরি অপরাধে না জড়ালেও ছেলে রফিকুল ইসলাম রুবেলকে দিয়ে নানা অপকর্ম করানোর অভিযোগ রয়েছে। কাফরুল এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত এ কাউন্সিলরের ছেলে রফিকুল ইসলাম রুবেলকে ইয়াবাসহ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার আগে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে আসা ৪৫ জন শীর্ষ মাদক কারবারির মধ্যে জামাল মোস্তফার ছেলের নাম ১২ নম্বরে রয়েছে। এছাড়া এ কাউন্সিলরের ছেলে কাফরুলের বিভিন্ন সড়ক দখল করে সেখানে হকার বসিয়েছে। এসব হকারের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে থাকে। কাউন্সিলর জামাল মোস্তফার বিরুদ্ধেও রয়েছে সরকারি জমি দখলের অভিযোগ। এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে জাতীয় গৃহায়ন কর্র্তৃপক্ষের জমি দখল করে সেখানে প্লট বানিয়ে তা বিক্রির অভিযোগও পাওয়া গেছে। তবে কাউন্সিলর জামাল মোস্তফার দাবি, ষড়যন্ত্র করে তার ছেলেকে মাদক কারবারি সাজানো হয়েছে।
আবদুর রউফ নান্নু : ডিএনসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রউফ নান্নুর বিরুদ্ধে রাস্তা দখল করে মার্কেট নির্মাণ ও মাদক ব্যবসায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ কাউন্সিলর কয়েক বছর আগে মিরপুর ১১ নম্বর এলাকায় সড়কের একটি বড় অংশ দখল করে অর্ধশত দোকান বানিয়েছে। এ স্থানটি বর্তমানে ‘নান্নু মার্কেট’ নামে পরিচিত। সেখানে দোকানগুলো থেকে তিনি নিয়মিত ভাড়া আদায় করেন। এ কাউন্সিলরের দখলের কারণে সম্প্রতি ডিএনসিসি সেখানে রাস্তা নির্মাণ করতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরে মার্কেটের জায়গা বাদ দিয়ে রাস্তার করার ফলে তা সরু হয়ে যায়। সরকারের শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর এ কাউন্সিলর বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে ছিল বলেও জানা যায়।
জাকির হোসেন বাবুল : ডিএনসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেন বাবুলের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। বনানী এলাকায় ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চলমান শুদ্ধি অভিযানে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। বাবুল ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হলেও গুলশান, বারিধারা, শাহজাদপুর, নতুন বাজার, নর্দা ও কালাচাঁদপুরসহ আশপাশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। এসব এলাকার জমিদখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকা- চলে বাবুলের নির্দেশেই। জমিদখল ছাড়াও কড়াইল বস্তিতে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ফোরকান হোসেন : ডিএনসিসির ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ফোরকান হোসেনের বিরুদ্ধে আগারগাঁও-শেরেবাংলা নগর এলাকায় ফুটপাত দখল ও মাদক কারবারিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তার আপন ভাই ও নিজস্ব লোকজন দিয়ে আগারগাঁও আইডিবি ভবন থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সামনের রাস্তা পর্যন্ত সড়ক ও ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে। ডিএনসিসির একটি সভায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মাদক কারবার ও ফুটপাত দখলের অভিযোগ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত এ কাউন্সিলর তা প্রত্যাখ্যান করে পুলিশের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ ছুড়ে দেন।
তাজুল ইসলাম বাপ্পি : এ কাউন্সিলরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চৌকাঠ মাড়ানোর দরকার হয়নি। লেগুনা স্ট্যান্ডের লাইনম্যান ও পরে চাঁদা আদায়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত ৮-১০ বছরে রাজনীতির ছত্রছায়ায় ঘুরে গেছে জীবনের চাকা। সড়কের ধুলাবালির মলিন জীবন যার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল তিনি এখন ‘রাজার’ হালে জীবনযাপন করেন। আলিশান বাড়ি, একাধিক তৈরি পোশাক কারখানা, বিলাসবহুল গাড়ি, নামে-বেনামে কমপক্ষে ২০টি প্লট-ফ্ল্যাট, নিজের জমিতে মার্কেটসহ গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। এমনই তথ্য পাওয়া গেছে শূন্য থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া ঢাকা মহানগর (উত্তর) যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজুল ইসলাম বাপ্পি ওরফে ঝুট বাপ্পির বিরুদ্ধে। রাস্তা থেকে উঠে এসে ‘রাজা’ বনে যাওয়া এই নেতা সবই করেছেন সরকারি ও ব্যক্তির জমিদখল, পরিবহনে চাঁদাবাজি, গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে ঝুট ব্যবসা করে। প্রশাসনের চোখের সামনে এমন বেপরোয়াভাবে বেড়ে ওঠা বাপ্পির বিরুদ্ধে কারো টুঁ শব্দ করার সাহস নেই কারো। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাত-আট বছর আগে ওয়ার্ড রাজনীতি ও পরে পল্লবী থানা যুবলীগের পদটি পেয়ে ভাগ্যের চাকা বদলে নেন বাপ্পি। ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার আশীর্বাদ পেয়ে লেগুনার লাইনম্যান বাপ্পি এখন চলেন নিজস্ব গাড়ি বহর নিয়ে। এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা বাপ্পি ওরফে ঝুট বাপ্পি এখন লাইসেন্স করা অস্ত্র আর নিজস্ব নিরাপত্তাবেষ্টিত বহর নিয়ে এলাকায় মহড়া দেন।
চিত্তরঞ্জন দাস : টানা ১২ বছর রাজধানীর ‘বাসাবো-রাজারবাগ শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালী মাতা মন্দির’ কমিটির সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাস। এক সময়কার এই বিএনপি নেতা এখন সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলটিতে যোগ দেন তিনি। অভিযোগ আছে, তারপর আওয়ামী লীগের ওই আমল এবং গত ১১ বছরে অসহায় হিন্দুদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। মন্দিরকে বানিয়েছেন অপরাধমূলক কাজের আখড়া হিসেবে। মন্দিরের কোনো হিসাব দেন না কাউকে, লুটপাট করছেন কোটি কোটি টাকা ও দখলে নিয়েছেন জমির একটি অংশ। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকায় তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউই মুখ খোলার সাহস পান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন জানিয়েছেন, কালীমন্দিরের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছেন চিত্তরঞ্জন। যথেচ্ছ ব্যবহার করেন মন্দিরের অর্থ। অভিযোগ রয়েছে, মন্দিরের সম্পত্তি দখলে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় বাসাবোর পাটোয়ারীর গলির বহুল আলোচিত চাল ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তসুকে হত্যা করা হয় তার ইঙ্গিতে। ওই হত্যা মামলায় প্রধান আসামিও করা হয় তাকে। যে মামলাটি রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে ২০০৯ সালে। বাদী সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আবেদন নিয়ে এখনো দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তসু হত্যা মামলার বাদী মোখলেসুর রহমান সাচ্চু তার আবেদনে বলেন, চিত্তরঞ্জন ও তার সহযোগীরা মন্দিরকে ব্যবহার করে এলাকায় মাদকের কারবার, বেআইনি অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অনিয়ম করে আসছে।