ঢাকা শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


রাজধানীতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়ানো হচ্ছে বাড়ি ভাড়া

নতুন বছর এলেই আতঙ্কে ভাড়াটিয়ারা


২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:২৫

আপডেট:
২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:৪৫

# জানুয়ারী আসলেই বাসা ভাড়া বাড়ায়!
# দেওয়া হয় না বাড়ি ভাড়ার নিয়মতান্ত্রিক স্লিপ

# ব্যাচেলরদের কাছে থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়
# বিদ্যমান আইনকানুনকে তোয়াক্কা করেন না বাড়িওয়ালারা
# নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়ানোর অভিযোগ বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে
# যখন তখন উচ্ছেদ, তোয়াক্কা করেন না আইনকানুন!

 

চলছে বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর। এ মাসটি এলেই আতঙ্কে থাকেন রাজধানীর ভাড়াটেরা। অধিকাংশ বাড়িওয়ালাই জানুয়ারি মাসে বাড়িয়ে দেন বাড়ি ভাড়া। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এভাবে বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ভাড়াটেরা।

ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই ভাড়াটে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাড়িওয়ালাদের ৮০ শতাংশই বাড়ি ভাড়ার আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং ঢাকার ২৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়িওয়ালা ভাড়াটেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ভাড়াটেরা বাড়ি ভাড়া আইন সম্পর্কে না জানার কারণে বাড়িওয়ালাদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।

ক্যাব বলছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গড়ে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। আর এই ভাড়া বাড়ানোর কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে ৯ শতাংশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় এরই মধ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ভাড়া বাড়ানোর নির্দেশনা ভাড়াটেকে জানিয়ে দিয়েছেন বাড়িওয়ালারা।এ ব্যাপারে রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আহমেদ যুবায়ের সময়ের আলোকে বলেন, ‘গত জুলাই মাসে তিন বেডের একটি ফ্ল্যাটে উঠি। ২০ হাজার টাকা ভাড়ার ওই ফ্ল্যাটে পাঁচ মাস থাকার পরেই চলতি ডিসেম্বরে বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন আগামী মাস অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে ভাড়া আরও এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে।’

ঢাকার মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডে ভাড়া থাকেন তৌসিফা ইসলাম। ব্যাংকার তৌসিফা বলেন, ‘দুই বছর যাবৎ একটি ফ্ল্যাটে আছি। গত বছর জানুয়ারিতে এক হাজার টাকা বাড়িয়েছে। এবারও জানুয়ারিতেও এক হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে নোটিস দিয়েছে বাড়িওয়ালা। সঙ্গে বাড়তি আলাদা পানির বিলও দেওয়ার কথা বলেছে। যেটা আগে দিতে হতো না।’

শুধু বেশি ভাড়ার ফ্ল্যাটেই নয়, প্রতিবছর ভাড়া বাড়ে বস্তির খুপরি ঘরেও। জিগাতলার এমনই একটি বস্তিতে থাকেন আমেনা বেগম। তিনিও জানান, ‘জানুয়ারিতে ৫০০ টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে তাকে। নইলে ঘর ছেড়ে দিতে হবে।’


এ ছাড়া যখন-তখন বাড়ি ছাড়ার নোটিস, ঠিকমতো পানি না দেওয়া, নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা, রাতে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে বাড়ির মেইন গেট বন্ধ করে দেওয়া, ছাদে উঠতে না দেওয়া, বাসায় বেশি মেহমান থাকতে না দেওয়া, বাড়ি ভাড়ার নিয়মতান্ত্রিক স্লিপ না দেওয়া ও ব্যাংকে ভাড়া না নেওয়া, বেশি সদস্যের পরিবার ও ব্যাচেলরদের কাছে বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটাচ্ছেন রাজধানীর বাড়িওয়ালারা। এ ছাড়া ভাড়াটেদের সঙ্গে অনেক বাড়িওয়ালা ও তাদের পরিবার খারাপ আচরণ করে বলেও আভিযোগ আছে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার বাড়িওয়ালা মো. সাজু বলেন, ‘যে হারে সব কিছুর দাম প্রতিবছর বাড়ছে সে হারে আমি বাড়ি ভাড়া বাড়াই না। তবে কিছুটা না বাড়ালে আমিও চলতে পারব না। আর আমার বাড়ির সব ভাড়াটেদের সঙ্গে আমার পরিবারের খুবই ভালো সম্পর্ক। ভাড়াটেদের সঙ্গে খারাপ আচরণের প্রশ্নই আসে না।’

এদিকে, ক্যাবের সম্প্রতি বাড়ি ভাড়াসহ ২০১৯ সালের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে একটি জরিপ করেছে। ওই জরিপ বলছে, গত বছর ঢাকার দুই বেডের ফ্ল্যাট বাসায় (পাকা বাড়ি) ভাড়া বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে গড়ে ১৩ শতাংশ। পাকা ঘর কিন্তু ওপরে টিনের শেড এমন ঘরের ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বস্তি বাসার ভাড়া, প্রায় ১৭ শতাংশ।

ক্যাব বলছে, নিয়মনীতি ও বিদ্যমান আইনকানুনকে বাড়িওয়ালারা তোয়াক্কা করেন না। আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া এবং বিষয়টি দেখভালের জন্য সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষও নেই। সে কারণে বছর বছর বাসা ভাড়া বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের অসহায় ভোক্তাদের নাভিশ্বাসও। দ্রব্যমূল্য, হোল্ডিং ট্যাক্স, আয়কর, গ্যাস, পানির দাম বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির কারণে মূল শহর থেকে অনেক পরিবার উপশহরে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এতে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও যাতায়াতের ভোগান্তি বেড়েছে।

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। বর্তমানে প্রচলিত বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ এ বলা আছে, ‘কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্তে¡ও আদায়যোগ্য হবে না। মানসম্মত ভাড়া, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রক কর্তৃক) পুনর্র্নির্ধারণ করা যাবে। ভাড়াটে কর্তৃক ভাড়া পরিশোধ করা হলে বাড়ির মালিক তৎক্ষণাৎ ভাড়া প্রাপ্তির একটি রসিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করে ভাড়াটেকে প্রদান করবেন।’ কিন্তু এসব নিয়মের কোনোটারই প্রয়োগ ঘটে না বাস্তবে।

ক্যাব বলছে, ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই। এ বিষয়টি তদারকির কোনো ব্যবস্থাও নেই। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে চুক্তি সই এবং এ বিষয়ে পাকা রসিদ দেওয়ার ঘটনা একেবারেই বিরল। কাজেই এ খাতের ওপর গুরুত্বারোপ করতে আইনি কাঠামো গড়ে তোলা ও পৃথক বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন জরুরি। সিটি করপোরেশন এ ক্ষেত্রে ভাড়াটে ও বাড়ির মালিকের সঙ্গে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে বাড়ির মালিকেরা সংঘবদ্ধ হলেও ভাড়াটেরা কোনোভাবেই সংগঠিত নয়।’

বাড়ি ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য ঠেকাতে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটেদের তথ্য ভান্ডার থাকা, মালিকদের কর শনাক্তকরণ নম্বরের (টিআইএন) আওতায় আনা, শহরের মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবী ভাড়াটেদের জন্য সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে কম সুদে ফ্ল্যাট দেওয়ার ব্যবস্থা, সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড পর্যায়ে ভাড়াটে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করেছে ক্যাব।

এদিকে বাড়ি ভাড়া নিয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি রিট আবেদনে ২০১০ সালের ১৭ মে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিল। দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৫ সালের ১ জুলাই পর্যবেক্ষণসহ সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয় আদালত। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই ওই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বজলুর রহমান মারা যাওয়ায় বাদীপক্ষ আর রায়ের অনুলিপি পায়নি। পরবর্তীতে রিট মামলাটি বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চে আসে।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। ফলে ভাড়াটিয়া এবং বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন, অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা এতটাই বড় যে সেটা তারা পারছেন না। এ কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছে। আমরা রায়ের অপেক্ষায় রইলাম।’