ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


তবু আফসোস, যন্ত্রণা সাহসী উদ্ধারকর্মী সুমনের


৩০ মার্চ ২০১৯ ০৮:৩৪

আপডেট:
৩০ মার্চ ২০১৯ ০৮:৩৬

বনানীর এফআর টাওয়ার থেকে মই দিয়ে বহু মানুষকে বাঁচিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মী মো. শহীদুল আলম সুমন; কিন্তু শত অনুরোধের পরও মরিয়া হয়ে লাফিয়ে পড়া মানুষের জন্য তার কষ্ট কমছে না।

তিনি বলছেন, হাতজোড় করে অনুরোধ করেছিলেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দ্রুতই গিয়ে উদ্ধারের, তারপরেও উঁচু ভবন থেকে লাফ দেন তারা।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বহুতল ওই ভবনের অষ্টম ও নবম তলায় আগুন লাগে। তার উপরের ফ্লোরগুলোতে ছিলেন আটকেপড়ারা। ধোঁয়া ও আগুনের তাপে ধুঁকতে থাকা এই লোকগুলোকেই প্রথমে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন বলে জানান ফায়ার ব্রিগেডের স্টেশন অফিসার শহীদুল।

তবে আগুনের তীব্রতায় পিছু হটতে বাধ্য হন তারা, এরপরে সিদ্ধান্ত নেন আগে আগুন নিয়ন্ত্রণের। তখন দুটি মইয়ের মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণের পর আরেকটি মই দিয়ে আটকেপড়াদের নামিয়ে আনা শুরু করেন শহীদুল ও তার সহকর্মী ফায়ারম্যান সোহাগ চন্দ্র কর্মকার।

বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে দেখা যায়, আটকেপড়া লোকজনকে তারা যতবার মইয়ে তুলছিলেন ততবারই তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন উদ্ধার পাওয়ারা। তাদের সঙ্গে কাঁদতে দেখা যায় শহীদুলকেও।

শুক্রবার সকালে আবার ঘটনাস্থলে এসে আগের দিন আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষের জীবন বাঁচানোর ওই ঘটনা স্মরণ করেন তিনি।

শুক্রবার এফআর টাওয়ারের সামনে এসেছিলেন শহীদুল ইসলাম শুক্রবার এফআর টাওয়ারের সামনে এসেছিলেন শহীদুল ইসলাম শহীদুল ইসলাম  বলেন, ভবনে আটকেপড়াদের দুর্দশা ও তাদের উদ্ধার পাওয়ার আকুতি এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যাতে একপর্যায়ে তিনি নিজেও আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।
আটকেপড়াদের বারবার আশ্বস্ত করলেও একজন তার কথা না শুনে লাফ দেন উঁচু ওই ভবন থেকে।

শহীদুল বলেন, দড়ি বেয়েও নামতে চান দুয়েকজন। অপেক্ষা করলে হয়ত তারাও বাঁচতে পারতেন।

“বেশি খারাপ লেগেছে প্রথমে যে লোকটা লাফ দিয়েছে। ওই লোকটাকে তখন আমি মই দিচ্ছি। আমি তাকে বার বার চিল্লাইয়া হাত জোড় করে বলছিলাম, ভাই আপনি লাফ দিয়েন না। আমি আসতেছি, প্রমিজ করছি আমি আসতেছি। ওই লোকটা আমার কথা না শুনে লাফ দিয়েছে। এজন্য আমার মনটা খুবই খারাপ ছিল। এইজন্য বারবার আমি কান্নাও করছিলাম।”

শহীদুল বলেন, উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকা আতঙ্কিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে ঠিক রাখা কঠিন ছিল।

“একজন গর্ভবতী নারী ছিলেন, তিনি কান্না করছেন আর বলছেন ‘আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান। আমি মারা যাই আমার পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচান’। আমি উনার হাত ধরে বললাম, আমি মারা যাব কিন্তু আপনাকে উদ্ধার করব। তাকে নামিয়ে এনেছি।”

আগুনের তাপ ও ধোঁয়ার মধ্যে এভাবে একের পর এক আটকেপড়াদের নিয়ে আসেন শহীদুল ও সোহাগ আগুনের তাপ ও ধোঁয়ার মধ্যে এভাবে একের পর এক আটকেপড়াদের নিয়ে আসেন শহীদুল ও সোহাগ আটকেপড়াদের মধ্যে যারা তাদের কথা মতো কাজ করেছেন, তাদের কেউ মারা যায়নি বলে দাবি করেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “ধোঁয়া গ্রাউন্ড থেকে ৩০ সেন্টিমিটার উপরে থাকে। এজন্য শুয়ে থাকতে হয়। আমি বলেছি, শুয়ে থাকেন। আমি তাদের মাঝেমাঝে পানি দিয়েছি খাওয়ার জন্য। আগুনে পানি দিয়েছি যেন সেখান থেকে ধোঁয়া সরে গিয়ে অক্সিজেন পৌঁছে। এজন্য ওনাদের বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।”

আগুনের খবর পেয়েই পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কার্যালয় থেকে ইউনিট নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে আসেন শহীদুল। সেখানে আগে থেকেই আরও কয়েকটি ইউনিট ছিল। পৌঁছানোর পর তারা মানুষের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করলেও প্রচণ্ড তাপ আর ধোঁয়ায় সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।

“আমরা যেটা প্রথম চেষ্টা করেছি, মানুষের জীবন বাঁচানোর। আগুনটা পরে নিয়ন্ত্রণ করি। এজন্য আমি অনেকবার উপরে গেছি, আটকেপড়াদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু এত তাপ ছিল তাদের কাছে যেতে পারিনি আমরা। পরে সিদ্ধান্ত নেই আগে আগুন নেভাই পরে তাদের উদ্ধার করি।”

ঢাকায় আগুন লাগলে কোথাও পৌঁছানোটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন শহীদুল ইসলাম।

ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছাতে পারলে প্রাণহানি আরও কম হত বলে মনে করেন এই উদ্ধারকর্মী।

তিনি  বলেন, “আমরা যদি শুরুতে চলে আসতে পারতাম তাহলে এতগুলো লোক মারা যেত না। আমাদের আসতে ৪০ মিনিট সময় লেগেছে, এত যানজট ছিল!

আটকেপড়াদের যারা এই মইয়ে উঠতে পারছিলেন, তারাই শহীদুল-সোহাগকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলছিলেন আটকেপড়াদের যারা এই মইয়ে উঠতে পারছিলেন, তারাই শহীদুল-সোহাগকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলছিলেন “আমরা যদি ৫-১০ মিনিটের মধ্যে আসতে পারতাম তাহলে পরিস্থিতি হয়ত অন্যরকম থাকত। এছাড়া লোকজনের ভিড়ের কারণে গাড়িগুলো সেট করতেও কষ্ট হচ্ছিল।”
জ্বলন্ত ওই ভবন থেকে জীবিত যাদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের সবাই নেমে এসেছিলেন শহীদুল ও সোহাগ কর্মকারের হাত ধরে, তাদের এই মই দিয়ে।

কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের এই ভবনটিতে আগুন লাগার পরপর তার সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ।

ওই সময় একদল বিক্ষুব্ধ লোক ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের উপর চড়াও হয়েছিলেন উদ্ধার কাজে বিলম্বের কারণে।

এ বিষয়ে শহীদুল ইসলাম বলেন, “দমকলকর্মীরা সব সময় চেষ্টা করেন একজন মানুষও যেন মারা না যায়। আমরা চাই মানুষের জীবন বাঁচাতে, চোখের সামনে যদি কেউ মারা যায় সেটা সহ্য করতে পারি না।

“আমরা আসার আগে যা-ই হয় হোক, কিন্তু আমরা আসার পর যেন একটা লোকও মারা না যায় সেই চেষ্টা আমরা করি।”

ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করা শহীদুল ২০১৬ সালে ফায়ার সার্ভিসে স্টেশন অফিসার হিসেবে যোগ দেন।

বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আছেন তিনি। তার স্ত্রীও এই বাহিনীর কর্মকর্তা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সদরঘাটে বসবাস করেন শহীদুল।