এবার দেরিতে পাকবে আম
হাঁড়িভাঙার বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা ২০০ কোটি টাকা

স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় জিআই পণ্য স্বীকৃত সুস্বাদু হাঁড়িভাঙা আম জন্মে রংপুরে। তবে এবার নির্দিষ্ট সময়ের মাসখানেক পর এই আমের মুকুল গাছে আসে। তাই এবার ভোক্তার কাছে দেরিতে যাবে আম। প্রতিবছর জুনের ২০ তারিখে হাঁড়িভাঙা আম আনুষ্ঠানিকভাবে বিপণন শুরু হলেও এবার তা দেড় থেকে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে যাবে।
তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এর আগেও গাছ থেকে আম পাড়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে হাঁড়িভাঙা আম বিপণন না করতে চাষিদের পরামর্শ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এদিকে গেল কয়েকবারের মতো এবারও ২০০ কোটি টাকার ওপরে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি হবে বলে জানিয়েছে চাষি ও ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি বিভাগ জানায়, জানুয়ারি প্রথম দিকে সাধারণত হাঁড়িভাঙা আমের মুকুল দেখা গেলেও এবার রংপুরে আমের মুকুল এসেছে ফেব্রুয়ারিতে। বর্তমানে আমের বয়স প্রায় চার মাস। জুনের শেষ সপ্তাহ অথবা জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বাজারে মিলবে পরিপক্ব হাঁড়িভাঙা আম। এর আগে বাজারে হাঁড়িভাঙা আম পাওয়া গেলেও তা হবে অপরিপক্ব।
রংপুরের মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মূলত বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জকে ধরা হয় এই হাঁড়িভাঙা আমের রাজধানী। পদাগঞ্জের বিভিন্ন বাগান সরেজমিনে দেখা যায়, কৃষি বিভাগের পরামর্শ মেনে বর্তমানে বাগানগুলোতে আমের পরিচর্যা চলছে। শেষ সময়ে ব্যস্ত সময় পার করছে আমচাষীরা। দম ফেলার ফুসরত নেই চাষীদের। নির্দিষ্ট সময়ে আম বিপণন করতে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে লেগে পড়েছেন বাগনের যত্ন করতে।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আম পরিবহণের জন্য বিশেষ বাস ও ট্রেন সার্ভিস চালু, ন্যায্য দাম নিশ্চিতকরণে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি হাঁড়িভাঙা আমের রাজধানীখ্যাত পদাগঞ্জ হাটের রাস্তাঘাটের সংস্কার এবং হাটে আম বিক্রির শেড নির্মাণ, ব্যাংকিং সুবিধা বাড়ানো, পাবলিক টয়লেট স্থাপন ও বৃষ্টির সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।
রংপুর কৃষি বিভাগ জানায়, এ বছর রংপুর জেলায় আম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন হাজার ৩৫৯ হেক্টর। এর মধ্যে এক হাজার ৯১০ হেক্টরের বেশি জমিতে হাঁড়িভাঙা আম চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন হাঁড়িভাঙার ফলন হয়।
স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হাঁড়িভাঙা আম গত এক দশক ধরেই রংপুরকে ব্র্যান্ডিং করে যাচ্ছে। গতবছর এই পণ্যটি ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য তথা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। সেই স্বীকৃতির পর দ্বিতীয়বারের মতো চলতি মৌসুমে হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আসছে আর কিছুদিন পরেই।
এদিকে জাতীয়ভাবে পরিচিতি পাওয়ার পর এখন দেশের বাইরে হাঁড়িভাঙা আম রফতানির প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। গতবছর এই আম ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই আমটি মূলত উত্তরের জেলা রংপুরে আবাদ হয়। রংপুরের মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জ এলাকায় এ আমের বাগান বেশি। বিশেষ করে এই পদাগঞ্জ এলাকার একসময়ের অনাবাদি জমিতে এখন গড়ে উঠেছে আমের বাগান।
স্থানীয়রা বলছেন, পদাগঞ্জ থেকে শুরু করে রংপুরের বিভিন্ন স্থানে হাঁড়িভাঙা আমের ফলন হচ্ছে প্রায় ৩০ বছর ধরে। কিন্তু এই আমের তেমন একটা পরিচিতি ছিল না। ২০১৫ সালে ঢাকায় ফল মেলা হলে সেখানে এই আম পরিচিতি পায়। এর অনন্য স্বাদ ও গন্ধ মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে রংপুরের আম হিসেবে একনামে সারা দেশে পরিচিত হয় হাঁড়িভাঙা আম। সারাদেশেই তৈরি হয় এর কদর।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, হাঁড়িভাঙা আম গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর ডালপালা ঊর্ধ্বমুখী বা আকাশচুম্বী হওয়ার চেয়ে পাশে বেশি বিস্তৃত হতে দেখা যায়। ফলে উচ্চতা কম হওয়ায় ঝড়-বাতাসে গাছ উপড়ে পড়ে না, আমও কম ঝরে পড়ে। মাঘ-ফাল্গুন মাসে এই আমের গাছে মুকুল আসে। পাকতে শুরু করে আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ থেকেই।
আমটির উপরিভাগ বেশি মোটা ও চওড়া, নিচের অংশ অপেক্ষাকৃত চিকন। আমটি দেখতে সুঠাম ও মাংসালো, শ্বাস গোলাকার ও একটু লম্বা। আমের তুলনায় শ্বাস অনেক ছোট, ভেতরে আঁশ নেই। হাঁড়িভাঙা আম আকারের তুলনায় অন্য আমের চেয়ে ওজনে বেশি, গড়ে তিনটি আমে এক কেজি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি আম ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের হয়ে থাকে। পুষ্ট আম বেশিদিন অটুট থাকে। চামড়া কুচকে গেলেও পচে না। ছোট থেকে পাকা পর্যন্ত একেক স্তরে এই আমের স্বাদ একেক রকম। তবে আমটি খুব বেশি না পাকানোই ভালো বলে পরামর্শ কৃষি বিভাগের।
হাঁড়িভাঙার ইতিহাস
হাঁড়িভাঙা আমের গোড়াপত্তন করেছিলেন খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকার নামে এক ব্যক্তি। নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমজাদ হোসেন জানান, ১৯৪৯ সাল, তখন তার বাবা নফল উদ্দিন একটি গাছটি রোপণ করেছিলেন। একটি জমি থেকে দু’টি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তার বাবা। তবে একটি গাছ চুরি হয়ে যায়। বাকি গাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে পানি (ফিল্টার সিস্টেমে) দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে। সেদিন থেকেই গাছটির নাম হাঁড়িভাঙা আম গাছ।
তিনি আরও জানান, গাছটিতে এক সময় বিপুল পরিমাণ আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম সম্পর্কে জানতে চায়। তখন থেকেই গাছটি হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়। এখন হাঁড়িভাঙা আমের সুনাম মানুষের মুখে মুখে। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাগান। তিনি হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছটির সংরক্ষণের দাবি জানান।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, ‘জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া হাঁড়িভাঙা আম বিপণনে এবার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে বিষয়ে মনিটরিং করা হবে। বিশেষ করে পরিবহণে যাতে ব্যবসায়ীদের কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকারি পরিবহণ সুবিধার বিষয়টিও দেখা হবে।
তবে নির্ধারিত সময়ের আগে হাঁড়িভাঙা আম বিপণন না করতে চাষিদের পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল।