টেন্ডারবাজির নতুন নজির; সর্বোচ্চ দরেও কাজ পেল সৈকত এন্টারপ্রাইজ

নাসিরনগরের এলজিইডি প্রকল্পে টেন্ডার অনিয়মের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত, বিতর্কিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হলো ৫.২২ কোটি টাকার কাজ, আগেই হয়েছিল অভিযোগ ও মানববন্ধন, এবার বাস্তবতা হয়ে ধরা দিল।
নাসিরনগরের এলজিইডি বিভাগের একটি সড়ক ও কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি দরদাতা হয়েও কাজ পেয়েছে বহু বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'সৈকত এন্টারপ্রাইজ'। এ ঘটনায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা এলজিইডি অফিস সূত্রে জানা যায়, নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের কাঠালকান্দী থেকে ফেরিয়াকান্দী হয়ে গুজিয়াখাই গ্রাম পর্যন্ত তিনটি কালভার্টসহ সড়ক নির্মাণের জন্য ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২৫ সালের ৯ জানুয়ারি। টেন্ডার নম্বর ১০৬৫১২৫। প্রকল্পটিতে অংশ নেয় চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানড় বরেন্দ্র কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, জাকিউল্লাহ ব্রাদার্স লিমিটেড, মিম ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং সৈকত এন্টারপ্রাইজ। এর মধ্যে বরেন্দ্র কনস্ট্রাকশন সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও তাদের টেন্ডার বাদ পড়ে এবং পরে রিভিউ প্যানেল থেকে জামানত ফেরতের নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে সর্বোচ্চ দরদাতা সৈকত এন্টারপ্রাইজের প্রস্তাব গ্রহণ করে চূড়ান্তভাবে কাজটি তাদের প্রদান করা হয়। যদিও প্রতিষ্ঠানটির অতীত ইতিহাস নিয়ে রয়েছে ব্যাপক বিতর্ক।
সৈকত এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহিদা বেগম, যিনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুখ্যাত চরমপন্থী নেতা মুকুলের (আসল নাম আমিনুল ইসলাম) স্ত্রী। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন জেলার টেন্ডারে অংশ নিয়েও সময়মতো কাজ শেষ না করা, কাজের মান না রাখা, এবং জোড়াতালি দিয়ে দায়সারা কাজ করার ইতিহাস রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
দৌলতপুর, বগুড়া, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সৈকত এন্টারপ্রাইজ কাজ নিয়ে নানা বিতর্কে জড়িয়েছে। প্রথম সারির এক দৈনিকে একটি সড়ক প্রকল্পে তাদের কাজ নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়, যেখানে জোড়াতালির কাজের কথা উল্লেখ করা হয়।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি আশ্রয় নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার 'হাসান এন্টারপ্রাইজ' নামক আরেক বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ছায়ায়।
স্থানীয় সূত্র বলছে, হাসান এন্টারপ্রাইজের মালিকের সঙ্গে সাবেক মন্ত্রী উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এই সম্পর্কের জোরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এলজিইডি প্রকল্পগুলোর ৫৩ শতাংশ কাজ তারা দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় এই অনিয়মের আশঙ্কা আগে থেকেই প্রকাশ করে স্থানীয়রা। গত ১০ মার্চ নাগরিক সমাজ মানববন্ধন করে এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ ও পুনর্মূল্যায়নের আবেদন জমা দেয়। তারা দাবি করেছিলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। অভিযোগকারীরা আরও জানান, যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতীতে অনিয়ম, অপরাধী সংযোগ এবং কাজের গুণগত মান নিয়ে এত অভিযোগ রয়েছে, তাদেরকে এত বড় প্রকল্প দেওয়া হলে জনগণের টাকায় উন্নয়ন নয়, হবে দুর্নীতি।
স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করছেন, পূর্বের অভিযোগগুলোকে উপেক্ষা করেই এই বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হলো। তারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন, এই প্রকল্পও হয়তো দৌলতপুরের সড়কের মতো অর্ধেক কাজ হয়ে পড়ে থাকবে বা নিম্নমানের কাজে অল্প সময়েই ধসে পড়বে। নাসিরনগরের স্থানীয়দের দাবি, অবিলম্বে প্রকল্পটি তদন্ত করে সঠিক প্রক্রিয়ায় নতুনভাবে কার্যাদেশ দেওয়া হোক। নয়তো উন্নয়নের নামে দুর্নীতির পথ আরও প্রশস্ত হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ এমদাদুল হক বলেন, সর্বনিম্ন দরদাতাদের সকল কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই যাদের পূর্বের কাজের অভিজ্ঞতা বেশি অথবা যাদের বেশি কাগজপত্র সাবমিট করা হয়েছে তাদের নাম রেজুরেশন দিতে হয়। কোন প্রতিযোগি যদি মনে করে, তাহলো তারা অবশ্যই অভিযোগ জানাতে পারে। প্রতিটি টেন্ডারেই একইভাবে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে।