ঢাকা রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


কর্মরত প্রায় সাড়ে ৫ লাখ

বিদেশি কর্মীদের পকেটে বছরে যাচ্ছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা


১৮ জানুয়ারী ২০২০ ১৩:২৯

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০০:৪০

সরকারি হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজারের মতো। এর মধ্যে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ২৩ লাখ ৭৭ হাজার এবং অশিক্ষিত ৩ লাখ। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা কোটির ওপরে। অথচ এত বেকারের দেশে কাজ করছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ বিদেশি কর্মী। উচ্চ বেতনে তারা দেশের গার্মেন্ট খাতসহ বিভিন্ন খাতে চাকরি করে বছরে নিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গার্মেন্ট খাতে কর্মরত বিদেশিদের নিয়ে বছর খানেক আগে একটি গবেষণা করে। 
 
তাতে দেখা যায় দেশের মোট ৩ হাজার ৮০০ কারখানার মধ্যে ১৩ শতাংশ করাখানায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন বিদেশিরা, যা সংখ্যায় হয় ৪০০ কারখানার মতো।
 
আরেক সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) তথ্য মতে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে কাজ করছে ২০ হাজারের অধিক বিদেশি কর্মী। কিন্তু এই ২০ হাজার কর্মী যা বেতন নিচ্ছে তা গার্মেন্ট খাতে দেশীয় মোট শ্রমিকের প্রায় অর্ধেকের সমপরিমাণ মজুরি নিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু সুনিদৃষ্ট পদে দক্ষতার দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে দেশের শ্রমিকরা। দেশি শ্রমিককে দক্ষ করে গড়ে তুলে এই বিশাল অঙ্কের টাকা দেশে রাখা সম্ভব।
 
এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, সিপিডি গবেষণা করে দেখেছে মূলত দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতে কি পরিমাণে বিদেশি কর্মী কাজ করে, কোন কোন পদে তারা কাজ করে এবং তারা বছর শেষে কি পরিমাণে অর্থ বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যায়। এতে আমরা দেখেছি মোট পোশাক কারখানার ১৩ শতাংশে বা ৪০০ টিতে কাজ করে বিদেশি দক্ষ শ্রমিক এবং তারা বেশ মোটা অঙ্কের টাকা প্রতি বছর নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।
 
আমরা আমাদের গবেষণায় উল্লেখ করেছি, এসব বিদেশি শ্রমিক চাকরি করছে মূলত ম্যানেজার ও এইচআর লেভেলে। বলা হয় এসব পদে দেশে দক্ষ কর্মী নেই। আসলে তাদের সঙ্গে আমাদের গ্যাপগুলো কোথায় আমরা সেটি নিয়েও কাজ করেছি। এতে দেখা যায়, দেশীয় শ্রমিকের চেয়ে বিদেশি এসব কর্মীরা অনেক দক্ষ। তাদের সমকক্ষ করতে হলে আমাদের দেশের শ্রমিকদের একাডেমিক ওরিয়েন্টেশন দরকার। তা ছাড়া এসব পদের জন্য কাজ করতে করতে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে না যেয়ে চাকরিতে ঢোকার আগেই এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তাহলেই সম্ভব বিদেশি উচ্চ বেতনের শ্রমিকের জায়গায় দেশি শ্রমিক পাওয়া। আর এটা সম্ভব হলে প্রতি বছর যে হারে দেশীয় টাকা বিদেশ চলে যাচ্ছে তা দেশে রাখা সম্ভব হবে।
 
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীর প্রশ্নের জবাবে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জানান, পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এর মধ্যে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ২৩ লাখ ৭৭ হাজার এবং অশিক্ষিত ৩ লাখ। তিনি আরও জানান, অশিক্ষিত ৩ লাখ বেকারের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২৭ হাজার এবং নারী ১ লাখ ৭৩ হাজার। প্রাথমিক পাস বেকারের সংখ্যা ৪ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ২ হাজার, নারী ২ লাখ ২৬ হাজার। মাধ্যমিক পাস ৮ লাখ ৯৭ হাজার বেকারের মধ্যে পুরুষ ৪ লাখ ২২ হাজার ও নারী ৪ লাখ ৭৪ হাজার। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বেকার ৬ লাখ ৩৮ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৩ লাখ ৫৩ হাজার ও নারী ১ লাখ ৭১ হাজার। বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে ৪ লাখ ৫ হাজার বেকারের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩৪ হাজার আর নারী ১ লাখ ৭১ হাজার। কিন্তু পিআরআইয়ের তথ্যমতে দেশে বেকারের সংখ্যা এক কোটির ওপরে।
 
শ্রম প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৫৭ লাখের বেশি। এর মধ্যে পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লাখ ৭৪ হাজার ৪৯৮ জন। তৈরি পোশাক শিল্প ব্যতীত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক সংখ্যা ৩১ লাখ ২৩ হাজার ৩৭০ জন।
 
এদিকে পিআরআইয়ের তথ্য অনুসারে বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশ থেকে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা (১ ডলার = ৮৩ টাকার হিসাবে)। জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করছেন। অথচ বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে ১ লাখ। তাদের আয়ের ওপর সরকার যথাযথভাবে করও পাচ্ছে না। কাউকে বেতন দেওয়া হচ্ছে বিদেশে। আবার এ দেশেও অনেককে ডলারে বেতন দেওয়া হয়। অথচ আয়কর বিবরণীতে তারা এটা টাকার অঙ্কে দেখান। আর নিবন্ধনহীনরা তো কিছুই দেখান না।
 
আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সরকারের বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি কর্মী নিয়োগে অনেক ক্ষেত্রে বিডা থেকে অনুমতি নেওয়া হয় না। এভাবে এ দেশে কাজ করছেন ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির লোকেরা। বলা হয়, এরা দক্ষ কর্মী। আমাদের দেশে তাদের মানের কর্মী পাওয়া যায় না। সর্বাধিকসংখ্যক বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত। নিয়োগদাতাদের মতে, বাংলাদেশে ফ্যাশন ও ডিজাইনিং, ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনা, বিপণন, সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি খাতে দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করতে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন, উৎপাদন ও রফতানি কার্যক্রম চালু রাখতে হচ্ছে।
 
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা ও শিল্প বণিক সমিতি বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, যেকোনো বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করতে চাইলে বিডা থেকে ওয়ার্ক পারমিট নেওয়ার বাধ্যতামূলক বিধান রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বেসরকারি এমনকি কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। এ নিয়ম না মানায় সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
 

তথ্যমতে, দেশে যতো বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে ভারতীয় নাগরিক বেশি। এ ছাড়া চীন, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অর্ধ শতাধিক দেশের নাগরিক এখানে বৈধ-অবৈধভাবে কাজ করে। তারা  বৈধ-অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থও নিয়ে যাচ্ছে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের তথ্য মতে এদেশে ভারতের প্রায় ৩ লাখ মানুষ কাজ করে এবং ভারতীয়রাই বেশি অর্থ নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে