ঢাকা সোমবার, ২রা জুন ২০২৫, ২০শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


শাহবাগে এ টি এম আজহারুল ইসলাম

‘আমি এখন স্বাধীন’


২৮ মে ২০২৫ ১৩:১৪

আপডেট:
২ জুন ২০২৫ ১৭:২৩

মুক্তি পাওয়ার পর শাহবাগে সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার পরপরই শাহবাগে গেলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম; বললেন, তিনি এখন মুক্ত ও স্বাধীন।

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ৭৩ বছর বয়সী আজহার কারা হেফাজতে চিকিৎসার জন্য ছিলেন ঢাকার শাহবাগের বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক বিএসএমএমইউ)।

আপিল বিভাগের রায়ের একদিন পর বুধবার বুধবার সকাল ৯টার পর সেখান থেকেই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পেয়েই একটি গাড়িতে করে পাশের শাহবাগ মোড়ে উপস্থিত হন আজহার। সেখানে তার দল জামায়াতে ইসলামী তাকে বরণ করতে সমাবেশ আয়োজন করেছিল।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে এই শাহবাগেই ২০১৩ সালে গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিচারে জামায়াতের শীর্ষনেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় এসেছিল। সেই শাহবাগে মোড়ে বুধবার সড়কের মাঝখানে পূর্বমুখী করে তৈরি করা মঞ্চে থাকা জামায়াত নেতারা ফুল দিয়ে বরণ করে নেন দলীয় সহকর্মী আজহারকে। এরপর সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি, টুপি এবং চোখে চশমা পরা আজহার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, “প্রায় ১৪ বছর কারাগারে থাকার পর আজ আমি মুক্ত। আজ আমি স্বাধীন। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক আমি এখন।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ছয় ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৪ সালে আজহারকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আজহার আপিল করলে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায়ে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশই বহাল রাখে। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আপিল বিভাগ রিভিউ শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে আজহারের মুক্তির আদেশ দেয়।

আজহার এজন্য আদালতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “মহামান্য আদালতকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, তারা ন্যায়বিচার করেছেন। এতদিন ন্যায়বিচার চিল না। আদালতকে ব্যবহার করা হয়েছে। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে আদালত জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন।”

এরপর আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানানোর পর জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা এই জামায়াত নেতা। তিনি বলেন, “ধন্যবাদ যাদের কারণে আজ আমি মুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি, সেই ৩৬ জুলাইয়ের, ৫ আগস্টের মহান বিপ্লবের নায়কদের। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আন্দোলনে স্বৈরাচার-ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হতে বাধ্য হয়েছিল। ধন্যবাদ জানাই ছাত্রসমাজকে, ছাত্রসমাজই রাজপথে রক্ত ঢেলে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছিল, যার কারণে নতুনভাবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেতে পেরেছে।”

সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষ নেওয়ায় আজ আমরা এই অবস্থানে আসতে পেরেছি।”

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগের শাসনকালে জামায়াতের যেসব নেতার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, তারা বিচারিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বলে দাবি করেন আজহার। জাময়াতের শীর্ষনেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা, মো. কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ‘শহীদ’ অভিহিত করে আজহার বলেন, তাদের ‘জুডিশিয়াল কিলিং’ করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে যারা যে পর্যায়ে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। এটা আমি জোর গলায় বলতে চাই। না হলে এই খারাপ সংস্কৃতি চালু থাকবে।”

সমাবেশে জানানো হয়, এখান থেকে আজহারকে নিয়ে মগবাজারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাবেন নেতা-কর্মীরা। জামায়াত আমির শফিকুর রহমানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টার এই সমাবেশ শেষ হয়। সঞ্চালক জামায়াত আমিরকে ‘ৈস্বরাচার পতন আন্দোলন’র নেতৃত্বদাতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে শফিকুর বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে বলেন, “এখানে বলা হয়েছে আমার নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, মোটেই না। এদেশের ১৮ কোটি মজলুম মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় সরকারের পতন হয়েছে। আমরা এই মূল ক্রেডিট আল্লাহকে দিই, জমিনের ক্রেডিট এই দেশের জনগণকে দেওয়ার পক্ষে।”

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়। তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতের শীর্ষনেতাদের অধিকাংশই বিচারের আওতায় আসে। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার পরের মাসের ৫ তারিখে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় আসে। কাদের মোল্লার রায়ের পর গড়ে ওঠে শাহবাগ আন্দোলন। তার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ দিয়ে আইন সংশোধন করা হয়। আগের আইনে শুধু দণ্ডিতেরই আপিলের সুযোগ ছিল।

এরপর আপিলের রায়ে কাদের মোল্লার সাজার মাত্রা বেড়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। আবার ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছিল জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর, কিন্তু আপিলের রায়ে তার সাজা কমে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় আসে। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজহারই প্রথম খালাস ও মুক্তি পেলেন। ২০১২ সালের ২২ অগাস্ট গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে বন্দি ছিলেন তিনি।

১৯৭১ সালে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘে যুক্ত ছিলেন আজহার। সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে আল বদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার ছিলেন তিনি। আজহার সে সময় ৭০ জন আল বদর সদস্যের একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। রংপুর সদরে আল বদর বাহিনীর সভা-সমাবেশে তার নেতৃত্ব দেওয়ার খবর পত্র-পত্রিকায়ও রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের ঠিক আগে আগে দেশ ছাড়েন আজহার। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি দেশে িফরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

জামায়াত তখন ছাত্র সংগঠন হিসাবে ইসলামী ছাত্র শিবিরকে গড়ে তুললে সেই কাজে নেতৃত্ব দেন আজহার। ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির হন। ২০০৫ সালে হন কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। একাত্তরে রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা চালিয়ে অন্তত ১৪০০ লোককে হত্যা এবং ১৪ জনকে খুনের অপরাধে আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দিেয়ছিল অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেই রায় উল্টে যাওয়ায় ক্ষোভ-বিক্ষোভও চলছে। মঙ্গলবারই বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ঢাকসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রতিবাদে মিছিল করে। বাম দলগুলোও বিবৃতি দিয়ে আজহারের মুক্তির প্রতিবাদ জানিয়েছে।