ঢাকা রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


কক্সবাজারের ‘যমদূত’ মিয়ানমারের হাকিম,খুজেঁ পাচ্ছে না পুলিশ


৪ নভেম্বর ২০১৯ ২৩:১৬

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০১:০৩


আবদুল হাকিম যেন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। এক সময়ের ডাকাত সর্দার হাকিম এলাকায় এখন ‘জঙ্গি নেতা’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক সংগঠন আরএসওর (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) অন্যতম সদস্য হাকিমের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এই এলাকার মানুষ।

গত ৪ অক্টোবর কক্সবাজার ঘুরে আরও জানা গেছে, প্রায় দুই যুগ ধরে এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন হাকিম। বলা হয়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই তার নিয়ন্ত্রণে। যাদের দিয়ে অপরাধ কর্মকান্ডে হাকিম গ্রুপের নাম পাওয়া যায়। পুরো এলাকাজুড়ে তার আছে বেতনভুক্ত সোর্স, ফলে হাকিমসহ অন্যরা বছরের পর বছর আছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সার্বক্ষণিক তার পাহারায় থাকে কয়েকজন সশস্ত্র ব্যক্তি। সব মিলে কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় যেন সাক্ষাৎ ‘যমদূত’ হাকিম।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন গতকাল রবিবার বলেন, ‘আবদুল হাকিম ও তার সহযোগীদের ধরতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে হাকিম দলবল নিয়ে পাহাড়-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকায় ধরতে সমস্যা হচ্ছে। হাকিম গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরেই অপরাধে জড়িত। ডাকাতির পাশাপাশি জঙ্গি কর্মকা-েও জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে তার বিরুদ্ধে।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অপরাধ করতে উসকে দেওয়ার অভিযোগ আছে হাকিমের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি মাদক কারবারসহ নানা অপরাধে সম্পৃক্ত তিনি। তার সঙ্গে বেশকিছু মাদক কারবারির সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাফ নদের তীরবর্তী পাহাড়ের আস্তানায় বসে হাকিম নিয়ন্ত্রণ করেন মিয়ানমার ও কক্সবাজারের মাদকসহ সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান পাচারে হাকিম গ্রুপকে ‘ভাগ’ (টাকা) দিতে হয়। বাংলাদেশে ইয়াবার চালান আসার পরও তাকে ‘ভাগ’ দিতে হয়। তার বাহিনীর সদস্যরাও সরাসরি ইয়াবার চালান এনে মজুদ করেন পাহাড়ের আস্তানায়। এভাবেই হাকিম বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে নাফ নদের এপার-ওপার। বাংলাদেশের ইয়াবা গডফাদাররাও তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই হাকিম বাহিনীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন।

মিয়ানমারের মোস্ট ওয়ান্টেড ‘খুনি’ হিসেবে সে দেশের সরকারের তালিকায় রয়েছেন হাকিম। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একাধিক পতাকা বৈঠকে তার বিষয়ে আলোচনায় হয়েছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে হাকিমের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশের এক কর্মকর্তা। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘হাকিম মিয়ানমারের মতো টেকনাফ-কক্সবাজারেও মোস্ট ওয়ান্টেড।

তার বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় খুনেরসহ বহু অভিযোগে মামলা রয়েছে। তাকে ধরতে পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে। হাকিমের আস্তানা গহীন অরণ্যে। সেখানে অভিযান চালাতে গেলেই সে গা ঢাকা দেয়। হাকিমের সোর্সের সংখ্যাও বেশি। পুলিশ নড়াচড়া করলেই সে জেনে যায়।’

টেকনাফের বন রেঞ্জের এক কর্মকর্তা বলেন, হাকিমের অস্ত্র ও অস্ত্রধারী সাঙ্গপাঙ্গ থাকার কারণে পাহাড়ে যাওয়াটাই রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার। টেকনাফ ও কক্সবাজার পৌরসভার দুই কাউন্সিলর জানান, টেকনাফের পাহাড়ে আস্তানা গেড়ে থাকা হাকিমকে যেকোনোভাবে আটক করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও তারা তার বিষয়ে কথা বলেছেন।

কে এই আবদুল হাকিম : মিয়ানমারের মংডু আনডাং কুলং বড়ছড়া এলাকার জানে আলম ওরফে জয়নাল আলীর ছেলে আবদুল হাকিম। মিয়ানমারে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন তিনি। মিয়ানমার সীমান্তের নানা অপরাধে জড়িত হাকিম সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তাকে খুন করার পর তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে হাকিম দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসেন টেকনাফে। সঙ্গে নিয়ে আসেন স্ত্রী-সন্তান ও পাঁচ ভাইকে। আরএসওর সঙ্গেও তারা সম্পৃক্ত। তার ভাই বশির আহমদ, কবির আহমদ, নজির আহমদ এবং হামিদ হোছনও নানা অপরাধে যুক্ত।

অভিযোগ আছে, কুতুবদিয়া দ্বীপে গিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জন্ম নিবন্ধনসহ ভোটার আইডিও তৈরি করে নিয়েছেন হাকিম ও তার ভাইয়েরা। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রীপাড়ার জহির আহমদ ওরফে গাছ জহিরের মেয়ে ইসমত আরাকে বিয়ে করেন হাকিম। ইসমতের ভাই নুইজ্জা হাকিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত। হাকিম বাংলাদেশে আসার পর প্রথমে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের পেছনের সরকারি বনভূমিতে ভবন করে বসবাস করেন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে অন্য জায়গায় চলে গেছে তিনি। তার প্রথম স্ত্রী শহরবানুর দুই সন্তান রয়েছে।

টেকনাফের পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানা : স্থানীয়রা জানায়, হাকিম বাহিনী টেকনাফের ফকিরামুরা ও উড়নিমুরা নামে পরিচিত গহীন বনের বিশাল এলাকায় গড়ে তুলেছেন আস্তানা। এখানে তার বাহিনীর অন্তত অর্ধশত অস্ত্রধারী ক্যাডারেরও বসতি রয়েছে। হাকিমের কাছে সার্বক্ষণিক থাকে দুটি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। থাকে একাধিক দেহরক্ষী। কক্সবাজার ও টেকনাফ শহরের বিভিন্ন স্থানে আছে তার একাধিক সোর্স। পাহাড়ের কোন স্থানে হাকিম কখন অবস্থান করেন তা এখন আর কেউ জানে না। তার আস্তানায় আছে নিজস্ব জেনারেটরও। তার বাড়ির ছাদে পানির ট্যাংক, সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ সরবরাহসহ অত্যাধুনিক ব্যবস্থা রাখা আছে। সব মিলে অরণ্যঘেরা পাহাড়েই এক সুরক্ষিত জঙ্গি আস্তানা গড়ে তুলেছেন তিনি। বছর দুয়েক আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একবার অভিযান চালিয়ে তার আস্তানা থেকে একটি স্যাটেলাইট ফোনসেটও উদ্ধার করেছিল। তবে তাকে ধরা সম্ভব হয়নি।

ডাকাত থেকে জঙ্গি নেতা : হালকা-পাতলা গড়নের আবদুল হাকিম মিয়ানমারের রাখাইনে থাকতেন। নাফ নদ তীরবর্তী এলাকায় ডাকাতি করতেন। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক কর্মকর্তাকে খুন করে টেকনাফে অনুপ্রবেশের পরও ডাকাতি করতে থাকেন। ডাকাত দলে ভেড়ান বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া অনেক রোহিঙ্গাকে। এসব কারণে সীমান্তের বাসিন্দাদের কাছে তিনি ‘ডাকাত’ হাকিম নামেই বেশি পরিচিত।

সীমান্তের প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য : নির্বিঘ্নে অপরাধজগতে টিকে থাকতে হাকিম কক্সবাজারের বেশ কয়েকজন ‘প্রভাবশালী ব্যক্তির’ সঙ্গে আত্মীয়তা করেন। ছোট ভাই নজির আহমদকে বিয়ে দেন স্থানীয় এমপি আবদুর রহমান বদির মামাতো ভাই জাহাঙ্গীরের মেয়ের সঙ্গে। নাজির টেকনাফ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামি। হাকিমও টেকনাফসহ আশপাশ এলাকার একাধিক হত্যা মামলার আসামি। অভিযোগ আছে, হাকিম ২০১৫ সালের ১২ জুন সেলিম ওরফে মুন্ডি সেলিমকে হত্যা করেন। নুরুল কবির নামে একজনকেও খুন করে হাকিম গ্রুপ। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের মংডুর বাসিন্দা নুরুল হকের ছেলে নুর হাফেজ ও নাইট্যংপাড়ার মৃত মোহাম্মদ কাশিমের ছেলে তোফায়েলকেও অপরহরণ করে হত্যার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এক সময় টেকনাফ পৌর এলাকার ১ ও ২নং ওয়ার্ড এবং টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বড় অংশ জুড়ে ছিল হাকিম বাহিনীর লোকজনের আধিপত্য। হাকিম গ্রুপের অত্যাচারে টেকনাফ স্থলবন্দর বোট মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ফিরোজ আহমদ, তার ভাই মনির আহমদ, নুরুল কবির, স্থানীয় সুলতান আহমদ, মোজাহের মিয়া ওরফে গুরা মিয়া, নুরুল আলম ও জসিম পরিবার পালিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে।’ তিনি জানান, সুলতান আহমদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছেন, বছর দুয়েক আগে হাকিম ও তার দুই সহযোগী তার বাড়িতে আসে। পরিবারের সদস্যদের একটি কক্ষে আটকে রাখে। টাকা না পেয়ে তার ছোট ছেলে আলী উল্লাহকে উঠিয়ে নেওয়ার হুমকি দিয়ে ৩২ লাখ টাকা দিতে বলে। পরদিন টাকা ব্যবস্থা করার শর্তে তারা চলে যায়। পরে টাকা না দিয়ে এলাকা ছেড়ে পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান সুলতান। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, হাকিমের বিরুদ্ধে টেকনাফ মডেল থানায় তিনটি হত্যা মামলা এবং তিনটি অস্ত্র মামলা রয়েছে।