আতঙ্কের নাম ‘মব জাস্টিস’, শঙ্কিত সাবেক আমলাসহ অনেকে

বর্তমানে সারা দেশে একটি আতঙ্কের নাম ‘মব জাস্টিস’। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে মব কালচার প্রকটভাবে সমাজে হাজির হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টায় মাঝে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও সম্প্রতি আবার সেটি মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে।
গত ২২ জুন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাকে মব জাস্টিসের মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন করার পর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর সাবেক অনেক আমলা এবং আওয়ামী লীগের ‘গড়পড়তা’ নেতারাও মব আতঙ্কে রয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, ‘মব’ কালচার কেন এখনো চলমান রয়েছে। কেন এটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। এটা কি কেবলই আওয়ামী সুবিধাভোগী আমলা ও নেতাদের প্রতি ক্ষোভ নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলারও একটা ষড়যন্ত্র?
শুরুর দিকের অনেক ঘটনায় ‘কার্যত’ চুপ থাকলেও এখন মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে সরকার বেশ সরব। মব জাস্টিসের ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়াও শুরু করেছে তারা। মবের নামে সরকারকে বিব্রত করার কারও কোনো প্রচেষ্টা আছে কি না তাও এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
সাবেক সিইসি নুরুল হুদার সঙ্গে মবের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘গ্রেপ্তারের সময় সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও অভিযুক্তকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার বিষয়টি সরকারের নজরে এসেছে। তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা বেআইনি, আইনের শাসনের পরিপন্থি ও ফৌজদারি অপরাধ।’
এ ঘটনায় হওয়া মামলায় রাজধানীর উত্তরা থানা পুলিশ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ‘৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং নানা পর্যায়ে মানুষের যে ক্ষোভ, এগুলোর একটা আউটকাম হচ্ছে এই ধরনের সংঘবদ্ধ ঘটনাগুলো। তবে যত ক্ষোভই থাকুক না কেন, এসব ঘটনা (মব) কোনোভাবেই সমাজের জন্য, সুশাসনের জন্য ইতিবাচক নয়। এসব ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যারা এটা করে তারা অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে। আইনের চোখে এদের পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকার এই ব্যাপারে একেবারে জিরো টলারেন্স নীতিতে আছে। আইনি ভিত্তিতে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্ব দেওয়া হবে না।’
আতঙ্কে সাবেক আমলারা
সাবেক নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার সঙ্গে হওয়া ‘মব’-এর ঘটনায় ভয ও আতঙ্কে আছেন সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের অন্যান্য বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের আমলারা। তারা অশঙ্কা করছেন মব প্রশ্রয় দেওয়া হলে তারাও যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক সচিব বলেন, ‘আমরা সরকারের কর্মচারী ছিলাম। সরকারের এমপি-মন্ত্রী যারা ছিলেন তাদের হুকুম পালন করেছি। দীর্ঘদিন চাকরি শেষে যদি মবের শিকার হতে হয় তাহলে মান-সম্মান তো আর কিছুই থাকল না। যারা অন্যায় করেছে, আইনের মাধ্যমে বিচার হবে। আইনের বিচারের আগে এখন মব জাস্টিসের মাধ্যমে বিচার করা হচ্ছে; হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। আমরা ভয়ে আছি, আতঙ্কে আছি।’
কার্যক্রম নিষিদ্ধ, তবে ‘মব’ পিছু ছাড়ছে না
৫ আগস্ট-এর পর আওয়মী লীগের নেতারা বেশিরভাগ আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ দেশে লুকিয়ে আছেন, কেউ দেশের বাইরে চলে গেছেন। এদিকে সরকারও আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যেও মাঝে মধ্যে আওয়ামী নেতাকর্মীদের ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার খবর আসে। অনেক জায়গায় মব জাস্টিসের নামে নির্যাতন করে তারপর পুলিশে সোপর্দ করা হচ্ছে। এই ভয়ে এখন আওয়ামী লীগের একেবারে ‘গড়পড়তা’ বা গুরুত্বহীন নেতারাও লুকিয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
দলটির কেন্দ্রীয় এক নেতা নিজের অবস্থান ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের দলের নেতাকর্মীদের পেলেই মব জাস্টিসের নামে অত্যাচার করা হচ্ছে। কেউ অপরাধ করলে আইনের মাধ্যমে বিচার হোক। বিচারের আগে যেভাবে মব তৈরি করে নির্যাতন করা হচ্ছে তা অন্যায়। আমি কোথায় আছি বলতে চাই না, তবে বেঁচে আছি।’
মবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন, এখনও বলছেন। তারা তাদের কর্মীদের সর্তক করেছেন মব না করতে। তারপরও এটি থামানো যাচ্ছে না।
নুরুল হুদার সঙ্গে মবের ঘটনায় দলের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ‘ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন’ নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, আমরা মব কালচারে বিশ্বাস করি না, আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমরা চাই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আদালতের রায় বাস্তবায়ন হবে, বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকবে। সালাহ উদ্দিন বলেন, আমরা চাই, কোনো ব্যক্তি যতবড় অপরাধীই হোন না কেনো তার আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকার যেন ভোগ করার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে।
অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, অপরাধী যত বড়ই হোক, ‘মব জাস্টিস’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার সমর্থনযোগ্য নয়। গত তিনটি নির্বাচন ছিল শেখ হাসিনার একক নাটকীয় নির্বাচন। এসব নির্বাচনের সময়কার সকল নির্বাচন কমিশনারই ফ্যাসিবাদের অংশ। তবে তারা যত বড় অপরাধীই হোক, বিচার হবে আইনের মাধ্যমেই, মব জাস্টিসের মাধ্যমে নয়। মব জাস্টিস সমর্থনযোগ্য নয়।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন বলেন, ‘মবোক্রেসির মাধ্যমে লাঞ্ছিত হওয়ার পর বিতর্কিত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার গ্রেপ্তার হয়েছেন। মবোক্রেসি ও লাঞ্ছনার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। সরকার মবের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই মব উৎপাদনের সাথে সরকার জড়িত নয় কি?’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার যতদিন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হবে, ততদিন সমাজ থেকে মবোক্রেসি বন্ধ হবে না। মব উৎপাদনের দায় পুরোপুরি সরকারের। সরকারের দুর্বলতার কারণেই বারবার মবের ঘটনা ঘটছে।’
প্রসঙ্গত, গত ২২ জুন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে আটক করা হয়। আটকের আগে কিছু লোক তার বাসায় ঢুকে তাকে নানাভাবে অপদস্থ করেন। ওই সময় হেনস্থাকারীরা কেউ কেউ ফেইসবুকে লাইভও করেন। এমন একটি লাইভে দেখা যায় নূরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিচ্ছেন এক ব্যক্তি।