ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ই এপ্রিল ২০২৫, ৩রা বৈশাখ ১৪৩২


ক্যাম্পাসে উৎসব

শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন সাঁজে এসেছে বৈশাখ


১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:০৪

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:৪৪

অলংকরণ: সিফাত রাব্বানী

আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বিবেচনায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নববর্ষ উদযাপন বাঙালির বড় আয়োজন। আয়োজনে যেন ঘাটতি না থাকে সেজন্য শুরু হয় সর্বত্র প্রস্তুতি। ১৪৩২ বঙ্গাব্দে শোভাযাত্রার নামের আগে আবারো জায়গা করে নিলো 'আনন্দ'। নতুনত্বে ও নৈপুণ্যে তেমনি ফিরে আসবে হারিয়ে যাওয়া সকল লোকজ সংস্কৃতি, যুক্ত করবে পুরোনো আবেগ ও উৎকণ্ঠা। বাংলা নববর্ষ ঘিরে শিক্ষার্থীদের এমন সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি জানাচ্ছেন —

সিফাত রাব্বানী

 

‘ধর্ম-বর্ণ মিলিত হোক উৎসবে’

আব্দুল্লাহ আল-আমিন

মার্কেটিং বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

পহেলা বৈশাখ বাঙালির জীবনে এক নতুন আনন্দ আর উদ্দীপনা নিয়ে আসে। এটি শুধু একটি নতুন বছরের শুরু নয়, বরং বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। এই দিনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে মিলিত হয় উৎসবে। নববর্ষের সকালে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এক বিশেষ আকর্ষণ। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মেলা বসে, নাগরদোলা ও লোকনৃত্যের আয়োজন থাকে। ইলিশ-পান্তা খাওয়া হয় ঘরে ঘরে। আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়, যেখানে লোকশিল্প ও ঐতিহ্যের নানা উপকরণ তুলে ধরা হয় কিন্তু আমরা অনেকবছর যাবত দেখে আসসি যে আনন্দ শোভাযাত্রার নামে প্যাঁচা, হাতি, ঘোড়া, বাঘ ইত্যাদি নিয়ে শোভাযাত্রা করে কিন্তু আমার মনে হয় এগুলো পরিবর্তন করে বাংলাদেশের ঐতিহ্য নিয়ে শোভাযাত্রা করা উচিত যেমন ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্ত যুদ্ধ, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান। সর্বশেষ বলতে পারি পহেলা বৈশাখ বাঙালির ঐক্য ও ভালোবাসার প্রতীক। এই দিনটি আমাদের সংস্কৃতিকে ধারণ করতে ও নতুন করে বাঁচতে শেখায়। পুরোনো দিনের গ্লানি ভুলে নতুন করে জীবন শুরুর প্রতিজ্ঞা নেয় বাঙালি এই উৎসবে।

‘বাঙালির শিকড়, বৈশাখের শ্বাস’

মোহাম্মদ জুনাইদ গণিত বিভাগ,

কক্সবাজার সরকারি কলেজ

 

পহেলা বৈশাখ, শুধু একটি দিন নয়—এ এক দীর্ঘশ্বাসের মুক্তি, এক আবেগের স্নান। যেখানে আত্মা ধুয়ে ফেলে পুরোনো ব্যথা। পহেলা বৈশাখে মায়ের লাল শাড়ির ভাঁজে লেপ্টে থাকা হাসি আর পান্তা-ইলিশের ঘ্রাণ যেন সবচেয়ে বড় উৎসব! বৈশাখ শিশুর চোখে প্রথম উচ্ছ্বাস—নতুন জামা, মুখে রং, উৎসবের হইচই, নাগরদোলা, পুতুল নিয়ে বাড়ি ফেরার মুহূর্তগুলো হৃদয়ে দাগ কাটে। বৈশাখে নারীর কপালে লাল টিপ, খোঁপায় শিউলি ফুল, কাজলভরা চোখ আর উড়ন্ত চুল—এ যেন বৈশাখের বেপরোয়া এক প্রেমপত্র। বৈশাখ এলেই ‘মেলায় যাইরে’ গান উত্তাল জনতার বুক চিরে গর্জে ওঠে। যেখানে কাঁধে বাঁশি, কাঁচের চুড়ি আর জনতার মিছিল যেন এক আবেগের উৎসব—যার নাম ‘বাঙালিয়ানা’। পান্তা-ইলিশ, ভর্তার ঝাঁঝ, খিচুড়ি আর পায়েস—এসব খাবারে শুধু স্বাদ নয়, থাকে সংস্কৃতির ঘ্রাণ। গ্রামে লাঠিখেলা, পালাগান, আলপনার সাজ, হালখাতা আর ভোরবেলার রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন আগাগোড়া এক বসন্ত! আনন্দ শোভাযাত্রা কেবল মুখোশের শোভাযাত্রা নয়—এ এক রঙে মোড়া স্বপ্ন, যেখানে জাতি তার শিকড় আর সাহসকে বিশ্বমঞ্চে তোলে। পহেলা বৈশাখ শুধু ক্যালেন্ডারে বন্দী নয়, এ আমাদের সত্তার অন্তর্নিহিত বিপ্লবের নাম।

‘হারিয়ে যাওয়া বৈশাখি মেলা ফিরে আসুক’

ফাহমিদা আক্তার তৃষ্ণা

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

‘হারিয়ে যাওয়া সেই বৈশাখি মেলা’ - এই কথাগুলো শুনলেই মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ওঠে। বিশেষ করে যারা আগের সেই জাঁকজমকপূর্ণ বৈশাখি মেলা দেখেছেন, তাদের মনে স্মৃতিগুলো ভিড় করে আসে। গত কয়েক বছর ধরে, বিভিন্ন জটিলতা বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বৈশাখি মেলার সেই আগের রূপ দেখা যায়নি। বড় পরিসরের জমায়েত নিষিদ্ধ ছিল, তাই অনেক ঐতিহ্যবাহী মেলা বন্ধ থেকেছে বা সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হয়েছে।এছাড়াও স্থান সংকট,আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার জটিলতা,আধুনিক বিনোদনের প্রভাব,অর্থায়নসহ আরো নানা কারণে মেলার চিরচেনা রূপ যেন প্রায় হারানোর পথে।সেই অর্থে, আগের মতো বিশাল ও আনন্দমুখর বৈশাখি মেলা হারিয়ে গিয়েছিল। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে এবং ২০২৫ সালে (বর্তমান প্রেক্ষাপটে) বাংলাদেশে বৈশাখি মেলা আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় পরিসরে মেলার আয়োজন দেখা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ ফিরে আসছে এবং তারা আবার বৈশাখি মেলার সেই ঐতিহ্যবাহী আনন্দে শামিল হচ্ছে। প্রথমবারের মত আমাদের প্রিয় বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এই বছর বৈশাখি মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে। আনন্দ শোভাযাত্রাসহ থাকছে দিনব্যাপী উৎসব। প্রাণের সেই বৈশাখি মেলা হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি অনেকের মনে থাকলেও, বৈশাখি মেলার মূল চেতনা - বাঙালির নববর্ষ উদ্যাপন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা, আনন্দ ও মিলন এখনও বর্তমান। হয়ত সময়ের সাথে সাথে এর রূপ কিছুটা বদলাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব হিসেবে আজও টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে বলে আশা করা যায়।

‘আনন্দ শোভাযাত্রা: লোকজ ঐতিহ্য না লোক দেখানো সংস্কৃতি?’

নুসরাত জাহান অর্পিতা

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

বাঙালির নববর্ষ উদ্যাপনের একটি অনন্য অনুষঙ্গ আনন্দ শোভাযাত্রা। একসময় এটি ছিল শুভ শক্তির আহ্বান আর অশুভ শক্তি প্রতিরোধের প্রতীক- একটি লোকজ রীতির শুদ্ধ বহিঃপ্রকাশ । কিন্তু বর্তমানে এটি যেন হয়ে উঠেছে ফ্যাশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রদর্শনের উপলক্ষ্য। আড়ম্বরপূর্ণ সাজসজ্জা, বৃহৎ মাপের মুখোশ ও প্রতিকৃতি, এবং রঙিন পোশাকে সজ্জিত মানুষের মিছিল—সব মিলিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রা যেন এখন ‘ফটোসেশন’ আর ‘ট্রেন্ডি পোস্ট’-এর এক আদর্শ পটভূমি। রাজনৈতিক প্রভাব, অতিরঞ্জিত ব্যয় এবং স্পন্সরশিপ নির্ভরতা এই উৎসবের স্বাভাবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। লোকজ সংস্কৃতির শিকড় থেকে যেন আমরা ক্রমেই সরে যাচ্ছি। এ অবস্থায় ভাববার সময় এসেছে—আনন্দ শোভাযাত্রা কি আদৌ এখনও শুভ কিছুর বার্তা বহন করে, নাকি এটি কেবল কৃত্রিম সংস্কৃতিচর্চার এক প্রতীকমাত্র?

‘বাঙালির শিকড়ে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আনে নববর্ষ’

তওসিফ আহম্মেদ মাহিন

লোকপ্রশাসন বিভাগ,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পহেলা বৈশাখ হলো বাংলা বছরের প্রথম দিন, যা বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের এক গৌরবময় উৎসব। এই দিনটি শুধু একটি নতুন ক্যালেন্ডার বছরের সূচনাই নয়, বরং বাঙালি জাতির মিলনমেলার প্রতীক। পুরনোকে ভুলে নতুনকে বরণ করে নেওয়া হয় এই দিনে। দেশের সব জায়গায় নানা উৎসব এবং আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি উদ্যাপন করা হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বৈশাখি মেলার চমৎকার আয়োজন করা হয়ে থাকে,যেখানে হস্তশিল্প, পিঠা-পুলি, মাটির তৈজসপত্র, কাঠের খেলনা, এবং দেশীয় পোশাকের পসরা দেখা যায়। অন্যদিকে,লোকগান, বাউল সংগীত, জারিগান, পুতুলনাচ ও নাগরদোলার মতো বিনোদনগুলো লোকসংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। লোকসংস্কৃতি বাঙালির শিকড়ে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেই। নতুন বছরের সূচনায় সবাই পুরোনো গ্লানি ভুলে আশাবাদের নতুন আলোয় পথ চলার অনুপ্রেরণা পায়। গ্রামীণমেলা ও লোকসংস্কৃতি মানুষের মাঝে আত্মীক বন্ধন গড়ে তুলে যা আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

‘মেলা নয়, শেকড়ের টান’

সোহান ছৈয়াল

ইতিহাস বিভাগ,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

বৈশাখি মেলা শুধু বিনোদনের একটি উৎস নয়, বরং এটি আমাদের শেকড়ের টানে ফিরে যাওয়ার এক চমৎকার সুযোগ। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি মনে করি, এই মেলা আমাদের লোকসংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত করে তোলে। মেলায় হাতের কাজ, মাটির পণ্য, ঐতিহ্যবাহী খাবার আর লোকজ সংগীত আমাদের হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ জীবনের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। শহুরে জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও এই মেলা যেন শিকড়ে ফেরার ডাক দেয়। এটি শুধু আনন্দের নয়, শিক্ষারও একটি স্থান। তবে মেলায় শৃঙ্খলা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি। বৈশাখি মেলা আমাদের পরিচয় ও সংস্কৃতির এক অনন্য উৎসব।


পহেলা বৈশাখ, Pohela Baishakh, মেলা, বৈশাখি মেলা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার, কক্সবাজার সরকারি কলেজ