ঢাকা শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


নতুন সিইসি হাবিবুল আউয়াল: কে তিনি?


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:২৭

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০০:০৩

সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করবেন চারজন। তারা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান।

সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে শনিবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এই পাঁচজনকে নিয়োগ দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন।

দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ৬৬ বছর বয়সী হাবিবুল আউয়াল নেতৃতত্বাধীন এই কমিশনের পরিচালনায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে।

নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সব দলের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করতে তিনি কাজ করবেন।

নির্বাচন আইনের অধীনে গঠিত দেশের প্রথম এই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শনিবার হলেও কবে নাগাদ তারা শপথ নেবেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তবে গতবার নিয়োগের পরদিনই প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন শুরু করেছিল কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।

নূরুল হুদা কমিশন গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেওয়ার পর থেকে সাংবিধানিক সংস্থাটিতে পদগুলো শূন্য রয়েছে।

সিইসির শূন্য পদ পূরণ করতে যাওয়া হাবিবুল আউয়াল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে ২০১৭ সালে অবসর নিয়েছিলেন।

নতুন সিইসি হাবিবুল আউয়াল: কে তিনি?

মুন্সেফ হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া এই কর্মকর্তা দীর্ঘদিন আইন সচিবের দায়িত্বে ছিলেন।

তার আইন সচিব হিসেবে নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে ২০১০ সালে রায় দেয় আদালত। ওই পদে তার নিয়োগের সময় নীতিমালা মানা না হওয়ায় আদালত তার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে।

আইন সচিব থাকা অবস্থায় বিধিবহির্ভূতভাবে দুই বিচারককে অবসরে পাঠানো নিয়েও জটিলতায় জড়িয়েছিলেন হাবিবুল আউয়াল। সংসদীয় কমিটি এজন্য তাকে তলব করলে তিনি ওই ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ক্ষমাও চান।

ওই সব ঘটনার পর ২০১০ সালে এপ্রিলে ধর্ম সচিব করা হয় হাবিবুল আউয়ালকে। পরে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব করা হয়। ২০১৪ সালে সেখান থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব করে পাঠানো হয় তাকে। ওই বছরই পদোন্নতি পেয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব হন তিনি।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল হাবিবুল আউয়ালের। কিন্তু পিআরএল বাতিল করে তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেয় সরকার।

২০১৬ সালে আরও এক বছর বাড়ানো হয় চুক্তির মেয়াদ। এরপর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকেই জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে ২০১৭ সালে অবসরে যান তিনি।

হাবিবুল আউয়ালের বাবা কাজী আবদুল আউয়াল কারা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বাদী ছিলেন তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) আবদুল আউয়াল।

৪ কমিশনার

নতুন চার নির্বাচন কমিশনার (বাঁ থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে)- রাশেদা সুলতানা এমিলি, আহসান হাবীব খান, আনিছুর রহমান ও মো. আলমগীর।

নতুন চার নির্বাচন কমিশনার (বাঁ থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে)- রাশেদা সুলতানা এমিলি, আহসান হাবীব খান,

আনিছুর রহমান ও মো. আলমগীর।

নতুন চার নির্বাচন কমিশনার (বাঁ থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে)- রাশেদা সুলতানা এমিলি, আহসান হাবীব খান, আনিছুর রহমান ও মো. আলমগীর।

 

নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া রাশেদা সুলতানা এমিলি সিরাজগঞ্জের সন্তান। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সবশেষ রংপুরে জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে গাইবান্ধায়ও জেলা জজের দায়িত্ব ছিলেন। ১৯৮৫ ব্যাচের জুডিশিয়াল সার্ভিসের এ কর্মকর্তা ২০২০ সালে অবসরে যান।

  

 

 

 

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান  হাবীব  খান সবশেষ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এর আগে তিনি প্রেষণে বিটিআরসি’র ডিজি ছিলেন। তিন বছরের জন্য বিটিআরসির স্পেকট্রামের মহাপরিচালক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

এছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত বিটিআরসিতে একটি প্রকল্পে এক বছরের জন্য মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন এই সেনা কর্মকর্তা। ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান আহসান।

মো. আলমগীর ২০২১ সালের নির্বাচন কমিশনের সচিব থাকা অবস্থায় অবসরে যান। কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসিতে সিইসি ও সচিবের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধের মধ্যে আলোচিত ছিলেন তিনি। মাহবুব তালুকদারসহ চার নির্বাচন কমিশনার একাট্টা হয়ে এ সচিবের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন।

২০১৯ সালের মে নির্বাচন কমিশনে আলমগীর সচিব পদে যোগ দেওয়ার পর তাকে নিয়ে আপত্তি তুলেছিল বিএনপি।

এর আগে তিনি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ছিলেন। মানিকগঞ্জের সন্তান আলমগীর প্রশাসন ক্যাডারে ৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।

আনিছুর রহমান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সচিবের দায়িত্ব পালন করে ২০২০ সালে অবসের যান।

শরীয়তপুরের সন্তান আনিছুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ হতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৮৫ ব্যাচের বিসিএস (প্রশাসন) কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।

২০১৭ থেকে তিন বছর ধর্ম সচিবের দায়িত্ব পালনের পর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে সচিব হন তিনি।

আইনের অধীনে প্রথম ইসি গঠন যে প্রক্রিয়ায়

ইসি গঠনে দীর্ঘদিন কোনো আইন ছিল না বলে তা নিয়ে ছিল সমালোচনা। এবার নতুন কমিশন গঠনের আগে আকস্মিকভাবেই আইন প্রণয়ন হয়, আর সেই আইনের অধীনে প্রথম নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নিতে চলেছেন কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ পাঁচজন।

‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ আইন প্রণয়ন হয় ২৭ জানুয়ারি। ওই আইনের ধারায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি।

সার্চ কমিটিতে সভাপতি ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান; সদস্য ছিলেন হাই কোর্টের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, লেখক-অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক, মহা হিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক (সিএজি) মুসলিম চৌধুরী এবং সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন।

সার্চ কমিটির দায়িত্ব ছিল সিইসিসহ ইসির প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজনের নাম ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা।

কমিটি প্রথমে রাজনৈতিক দলসহ সবার কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করে ৩২২টি নাম সংগ্রহ করে। এরমধ্যে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠক করেও মতামত নেয়।

সাতটি বৈঠকের পর গত বৃহস্পতিবার সার্চ কমিটি ১০ জনের চূড়ান্ত করে। তার দুদিন পর নিজেদের সুপারিশ রাষ্ট্রপতিকে দেয় তারা।

প্রথমে আসা ৩২২টি নাম প্রকাশ করলেও চূড়ান্ত সুপারিশে থাকা ১০টি নাম সার্চ কমিটি প্রকাশ করেনি।

ফলে এটা জানা যাচ্ছে না যে হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে আর কার নাম সার্চ কমিটি সিইসি হিসেবে প্রস্তাব করেছিল। আর কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়াদের বিপরীতে কার কার নাম ছিল, তাও এখন পর্যন্ত অজানাই থাকছে।

 

যারা ছিলেন সিইসি

দেশে এর আগে ১২ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং ২৭ জন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের অধিকাংশই কাজী হাবিবুল আউয়ালের মতোই অবসরপ্রাপ্ত আমলা।

এবার নিয়ে টানা চার বার সিইসি পদে নিয়োগ পেলেন সাবেক সচিব, যার শুরু হয়েছিল এ টি এম শামসুল ‍হুদার মাধ্যমে। শামসুল হুদার আগের কমিশনে একজন বিচারক থাকলেও তার আগে আবার ছিলেন আমলা।

১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতিরা। এরপর ইসিতে শুরু হয় সাবেক আমলাদের নেতৃত্ব।

মাঝখানে ২০০৫ সালে এক বছর সাত মাস একজন বিচারপতি ছাড়া গত প্রায় ২৫ বছর সাবেক আমলারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

পূর্ববর্তী সিইসিরা

কে এম নূরুল হুদা- ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২।

কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ- ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

এ টি এম শামসুল হুদা- ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি

বিচারপতি এম এ আজিজ- ২৩ মে ২০০৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০০৭

এম এ সাইদ- ২৩ মে ২০০০ থেকে ২২ মে ২০০৫

মোহাম্মদ আবু হেনা- ৯ এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে ৮ মে ২০০০

বিচারপতি এ কে এম সাদেক- ২৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৯৬

বিচারপতি আব্দুর রউফ- ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫

বিচারপতি সুলতান হোসেন খান- ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০

বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মাসউদ- ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০

বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম- ৮ জুলাই ১৯৭৭ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫

বিচারপতি মো. ইদ্রিস- ৭ জুলাই ১৯৭২ থেকে ৭ জুলাই ১৯৭৭

সিইসির দায়িত্বে বিচারপতিদের মধ‌্যে মো. ইদ্রিস ও এটিএম মাসউদ এবং সাবেক আমলাদের মধ‌্যে এম এ সাঈদ, শামসুল হুদা, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও নূরুল হুদা পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন।