ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


ঢামেকে ৮০ ভাগ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রই মেয়াদোত্তীর্ণ!


২৯ মার্চ ২০২১ ০৪:০৩

আপডেট:
১৭ মে ২০২৪ ১২:০১

মাঝেমধ্যে বৈদুতিক শর্টসার্কিট থেকে ছোটখাটো আগুনের সূত্রপাত হয়

বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো ফল মেলেনি

আগুন নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ও পুরাতন ভবনের গড়ে ৮০ ভাগ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দেড় থেকে দুই মাস আগেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যেগুলোর মেয়াদ আছে সেগুলোও চলতি বছরের মাঝামাঝি ও শেষের দিকে শেষ হয়ে যাবে। মেয়াদ থাকা বেশকিছু মেশিনে তারিখে রয়েছে ঘষামাঝা, আবার কোনো কোনোটিতে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখই লেখা নেই।

হাসপাতালে সরেজমিনে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন পরিবর্তন না করায় রোগী ও তাদের স্বজন, নার্স, চিকিৎসক, কর্মচারীরা, আনসার সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, মাঝেমধ্যে বৈদুতিক শর্টসার্কিট থেকে ছোটখাটো আগুনের সূত্রপাত হয়। তবে সেগুলো এমনিতেই নিভে যায়। ত্রুটিপূর্ণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা তাদের সকলের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো ফল মেলেনি। এর মধ্যে করোনা ইউনিটের আইসিইউতে আগুন লাগার আতঙ্ক আরও বেড়েছে।

মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) খন্দকার আব্দুল জলিল  বলেন, ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিনের মেয়াদ এক বছর থাকে। মেয়াদ শেষ হলে এর ভেতরের মেডিসিনের কার্যকারিতা আর থাকে না। এর প্রেশারও কমে যায়। ফলে অবশ্যই তখন রিফিল করতে হবে।’

উল্লেখ্য, গত বুধবার সকালে হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলার করোনা ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আগুন লাগে। রোগী স্থানান্তরের সময় ধোঁয়া ও অক্সিজেনের অভাবে তিন রোগী মারা যান। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন আইসিইউতে আগুন লাগার পর তারা ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন ব্যবহার করতে গেলে সেগুলো কাজ করেনি।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার সাবেক ডিজিএম (ট্রান্সপোর্ট) কিশোর চন্দ্র রায় (৭০) ওই ঘটনায় নিহত হন। তার মেয়ে সীমা রায়  বলেন, আমার বাবা ছিলেন ৮ নম্বর বেডে। আর আগুন লাগে ১২ নম্বর বেডের কাছে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমার বোনের স্বামী বাইরে থেকে ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু একটাও কাজ করেনি।

গতকাল হাসপাতালের নতুন ও পুরাতন দুই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন মেয়াদ উত্তীর্ণ। পুরাতন ভবনের প্রায় ৯৫ ভাগ আর নতুন ভবনের ৬০ ভাগ মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মেশিনের মেয়াদ শেষ। হঠাৎ আগুন লাগলে এগুলো কোনো কাজেই আসবে না। তবে মোট কতগুলো মেশিন সেখানে আছে তার সঠিক তথ্য তারা দিতে পারেনি।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালের পুরাতন ভবনের জরুরি বিভাগের ফটক দিয়ে প্রবেশের পর দেখা ‘পোস্ট কভিড-১৯ ক্লিনিক’, ‘ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টার’সহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ রয়েছে। ওই সব কক্ষের বাইরে দিয়ে দেয়ালে অন্তত ১৩টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন রয়েছে যার ১১টিই মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি।

ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টারের ভেতরে গিয়ে দেখা যায় আগুন নিয়ন্ত্রণে ভেতরে কোনো ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিনই নেই। সেখানে কর্মরত চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলে লাভ কী। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন।’ তবে সেখানে দায়িত্বরত একাধিক সিনিয়ার স্টাফ নার্স  বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে আমরা খুবই ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছি। এখানে আগুন নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাইরে যেগুলো আছে সেগুলোরও মেয়াদ শেষ হয়েছে। এগুলো জানানো হয়েছে। কিন্তু ফল মিলছে না।’

পুরাতন ভবনের অপারেশন থিয়েটার, গাইনি বিভাগসহ অন্যান্য স্থানে থাকা ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিনের বেশিরভাগই মেয়াদ শেষ হয়েছে। জরুরি বিভাগ থেকে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে যাওয়ার রাস্তার পাশ দিয়ে অন্তত ৫০টি মেশিনের মধ্যে সব কটির মেয়াদ শেষ হওয়ার চিত্র দেখা গেছে। সেগুলোর স্থিরচিত্র ও ভিডিও ধারণও করেছে এ প্রতিবেদক। এ বিষয়ে গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. নাজমা হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মেয়াদ না থাকা অবশ্যই ভয়ের বিষয়।’

এ বিষয়ে ওই কক্ষে দায়িত্বরত নার্সদের কাছে জানতে চাইলে তারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

হাসপাতালের ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্সের সামনে ও ভেতরে থাকা তিনটি ফায়ার এক্সটিংগুইশারেরই মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেখানে থাকা সিনিয়র স্টাফ নার্স শারমিন বলেন, এখানে প্রি-অপারেটিভে ১৩টি ও পোস্ট অপারেটিভে ১১টি বেড রয়েছে। ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়টি ইনচার্জকে জানানো হয়েছে। পুরাতন ভবনের অন্যান্য স্থানেরও একই চিত্র।

হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচতলায় গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি দুটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন যার একটির মেয়াদ আছে তো আরেকটির মেয়াদ নেই। তবে টিকিট কাউন্টারের সঙ্গে থাকা একমাত্র ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৪ জানুয়ারি। এ বিষয়ে কাউন্টারে দায়িত্বরতদের কাছে জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করেননি।

এ ভবনেরই তৃতীয় তলায় রয়েছে কার্ডিও ভাসকুলার ওটি কমপ্লেক্স। সেখানে পোস্ট সিসিইউ ও আইসিইউ রয়েছে। ওই আইসিইউতেই আগুন লাগে। সেখানে কাউকে যেতে দিচ্ছে না দায়িত্বরত নিরাপত্তা প্রহরীরা। দূর থেকে একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন দেখা যায়। তবে পোস্ট সিসিইউর সামনে কোনো ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখা যায়নি।

সেখানে থাকা রায়হান নামে এক ব্যক্তি নিজেকে ওই বিভাগের স্পোশাল কর্মী দাবি করে বলেন, আগুন লাগার আগে এখানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন ছিল। পরবর্তী সময়ে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মেয়াদ ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’ সেখানে দায়িত্বরত কোনো নার্স ও চিকিৎসক কথা বলতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশ না করে এক প্রত্যক্ষদর্শী নিরাপত্তা প্রহরী এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রথমে অল্প অল্প ধোঁয়া বের হতে থাকে। এসময় রোগীর স্বজনরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিন দিয়ে আগুন নেভাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেগুলো কাজ করেনি। ফলে ফায়ার সার্ভিসের লোক আসতে আসতে পুরা আইসিইউ ধোঁয়ায় কালো হয়ে যায়।

এ বিষয়ে জানতে গতকাল দুপুরে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হকের অফিসে গেলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। পরে সন্ধ্যায় তাকে ফোন করলে ফোন কেটে দেন।

হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ  ফোনে বলেন, ‘মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। এমন তথ্য আমার কাছে নেই। বিষয়টি আমি খোঁজ নেব।’ তিনি বলেন, ‘যদি ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেশিনের কোনোটির মেয়াদ শেষ হয়, আমাদের নজরে আসলেই সেটি পাল্টে ফেলি। নতুন করে ভরে আনা হয়। এটি একটি কনটিনিউয়াস প্রসেস (ধারাবাহিক প্রক্রিয়া)। সব সময় চলমান থাকে।’