ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


ইরফান তার এই সশস্ত্র ১২ ক্যাডার নিয়ে এলাকায় চলাফেরা করতেন। এলাকার দখল ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে মদিনা আশিক টাওয়ারের ছাদে স্থাপন করেছিলেন টর্চার সেল।

হাজী সেলিম দখল ও ছেলে ইরফান চাঁদাবাজিতে বেপরোয়া!


২৮ অক্টোবর ২০২০ ০৯:১৬

আপডেট:
২৮ অক্টোবর ২০২০ ১০:০৫

ছেলে ইরফান সেলিমের কারণে নতুন করে আলোচনায় ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) হাজী মোহাম্মদ সেলিম। অতীতে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এই এমপি।

অতীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজী সেলিমের নাম। অন্যায় অনিয়মের পথ ধরেই তার উত্থান। আর নিজের সেই উত্থান আরও এগিয়ে নিতে তিনি রাজনীতিকে ‘সিড়ি’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সে কারণে তিনি বেছে নিয়েছেন ‘ক্ষমতার রাজনীতি’।

১৯৯৬ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার হাজী সেলিম জাতীয় নির্বাচনে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজ দল বিএনপি তাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয় এবং তিনি এমপি নির্বাচিত হন। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান বিএনপি প্রার্থী নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর কাছে।

মূলত ওয়ার্ড কমিশনার থাকার সময় থেকেই রাজধানীর লালবাগ, চকবাজারসহ পুরান ঢাকার একটি বড় অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। 

অভিযোগ আছে, হোল্ডিং নম্বর ৫৬/৩/বি রাজ নারায়ণ ধর রোড। লালবাগের তিনতলা এ বাড়িটির মালিক মো. আজিম উদ্দিন ও তার আট ভাইবোন। এ বাড়ির পাশেই রয়েছে হাজী সেলিমের ছোট্ট একটু জমি।

ওই জমিতে ভবন করতে গিয়ে তার নজর পড়ে পাশের তিনতলা ভবনের ওপর। জমিটি কব্জা করতে নানা কৌশল এঁটে আর হুমকি-ধমকি দিয়েও ব্যর্থ হন তিনি। এরই মধ্যে আজিম উদ্দিন যখন পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশে সৌদি আরব যান, তখন সুযোগ বুঝে তাদের তিনতলা ভবনটি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন হাজী সেলিম; ভবনের জমি নিয়ে নেন নিজ দখলে। এর পর গত ৯ বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেও জমিটি ফেরত পাননি আজিম উদ্দিন।

শুধু আজিম উদ্দিনই নন, এমন অন্তত ত্রিশজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের যাদের জমি নানাভাবে কব্জা করেছেন ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী সেলিম। দু-একজন তাদের পরিচয় জানালেও অধিকাংশ ভুক্তভোগীই তাদের নাম-ধাম গোপন রাখতে বদ্ধপরিকর। পাছে হাজী সেলিমের কাছে এ সংবাদ চলে যায়, এটিই তাদের উদ্বেগের কারণ। ভুক্তভোগী এসব মানুষ জানান, অন্তত দেড় শতাধিক বাড়ি, প্লট ও মার্কেট দখল করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই সাংসদ। রাজধানীর জুরাইন মৌজাতেও অনেকের জায়গা জবরদখল করে দেয়াল তুলে দিয়েছেন। তার ব্যাপক প্রতাপের কারণে ভুক্তভোগীরা কিছু বলতে পারছেন না। সেখানে প্লট বানিয়ে বিক্রি করছেন তিনি।

জমি, বাড়ি ও প্লট দখলের বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে হাজী সেলিমের মোবাইল ফোনে বারবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। চকবাজারের বাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

১৯৯৬ সালের আগে তিনি ছিলেন চকবাজার এলাকার বিএনপি সমর্থিত ওয়ার্ড কমিশনার। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চান তিনি। না পেয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। এর পর নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভও করেন। এর পরই লালবাগ, চকবাজার ও হাজারীবাগ এলাকায় গড়ে তোলেন তার একচ্ছত্র আধিপত্য। শুরুতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা হাজী সেলিমের বিরোধিত করলেও দিন-দিন তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তে থাকায় একপর্যায়ে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।

স্থানীয়দের অভিযোগ, হাজী সেলিম কমিশনার থাকা অবস্থায় বিভিন্ন ঘাট ও বাজার ইজারায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেও জমি দখল শুরু করেন মূলত সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই। তার আসনের আওতাধীন প্রতিটি ওয়ার্ডেই তিনি গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী অভিযোগ রয়েছে, সোয়ারিঘাট, চকবাজার এলাকার প্রতিটি মার্কেট থেকে মাসোহারা আদায়ে রয়েছে হাজী সেলিমের পৃথক একটি গ্রুপ। ট্রাকে ও লরিতে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেও দৈনিক ভিত্তিতে টাকা গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ১৯৯৬ সালের পর লালবাগ ও চকবাজার এলাকার মধ্যে যেখানেই খালি জমি পেয়েছেন, সেখানেই হাত পড়েছে হাজী সেলিমের। এ নিয়ে মুখ খুলতেও সাহস পায়নি কেউ। পুরান ঢাকার অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার হাজী সেলিমের নির্যাতনে পিষ্ট, যারা তাদের সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয়ে ওই এলাকাই ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

আমাদের দিনের সঙ্গে ত্রিশজনেরও বেশি ভুক্তভোগীর কথা হয়। তারা কেন নাম প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন- এমন প্রশ্নে বলছেন, হাজী সেলিম এখন আইনি বলয়ে আটকে পড়লেও এ বিপদ সাময়িক। এক সময় তার এ বিপদ কেটে যাবে। তখন তিনি কাউকেই ছাড়বেন না। অতীতেও এমন দেখা গেছে যে, যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের কাউকেই তিনি ছাড়েননি। তাই সম্পদ যা গেছে যাক, নতুন করে বিপদ ডেকে আনতে চাইছেন না তারা।

ধারণা করা হয়, ১৮৭০ সালে ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে নির্মিত হয় জাহাজ বাড়ি। ভবনটির মালিক ১৯২০ সালে বদু হাজির নামে এ সম্পত্তি ওয়াকফ করে দিয়ে যান। তার মৃত্যুর পর তার বড় সন্তান ফেকু হাজি ভবনটির দায়িত্বে ছিলেন। ফেকু হাজির মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে হাজি আবদুল হক ভবনটির তত্ত্বাবধান করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে পরিচিত এ ভবনটি ভাঙার বিষয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু গত বছর ঈদের আগের দিন হাজী আবদুল হক ওরফে হক সাহেব ওমরা করতে সৌদি আরব গেলে রাতের বেলা ভবনটি গুঁড়িয়ে দেন হাজী সেলিমের লোকজন। জানা গেছে, সেখানে একটি বহুতল মার্কেট করতে ইচ্ছুক হাজী সেলিম। বিষয়টি নিয়ে হাজি১ আবদুল হকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে ওই ভবনটি থাকাকালে সেখানে ব্যবসা করা মোসলেহউদ্দিন বলেন, কোনো রকমের আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে হাজী সেলিমের লোকজন ভবনটি ভেঙে ফেলেন।

কেবল জাহাজ বাড়ি ভেঙেই ক্ষান্ত হননি হাজী সেলিম। ভবনটির পার্শ্ববর্তী ৬নং হোল্ডিং থেকে ৪২২নং হোল্ডিং পর্যন্ত যারা মালিক কিংবা পজিশন কিনেছেন, তারা এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন। বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির প্যাডে দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, জাহাজ বাড়ির পরিত্যক্ত স্থানে মদিনা বিল্ডার্স নামের একটি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি নির্মাণকাজ শুরু করতে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, মদিনা বিল্ডার্সের মালিক হাজী সেলিম।

গত বছর থেকে এ মার্কেটের নির্মাণকাজ আরম্ভ করার পর থেকে নানা ধরনের হুমকি আসছে। মদিনা বিল্ডার্সের লোকজন বিভিন্নভাবে দোকানদারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। মার্কেট সমিতির বেশ কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আশপাশের পুরান ভবনগুলোর দোকানদারদের দোকান ছেড়ে দেওয়ার জন্য আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। আমরা দক্ষিণ সিটির মেয়র ও এফবিসিসিআই বরাবর চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে অবগত করেছি। তারা বলেন, আগেও দেখা গেছে যে জমিতেই মদিনা বিল্ডার্সের মালিক হাজী সেলিমের চোখ পড়েছে, সেই জমিই তিনি ছলে-বলে-কৌশলে হস্তগত করেছেন। তাই তারা ভীষণ ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে আছেন।

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকায় ১৪ শতাংশ জমির ওপর একটি দোতলা ভবন ছিল অগ্রণী ব্যাংকের। স্বাধীনতার পর নির্মিত ভবনটি অনেক পুরান হওয়ায় কিছুদিন আগে নতুন ভবনে শাখা স্থানান্তর করা হয়। এর পরই ভবনটির জমিতে নজর পড়ে হাজী সেলিমের।

ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ব্যাংকের শাখাটিও বন্ধ ছিল। এখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা প্রহরী ভোল্ট পাহারা দিতে ভেতরে অবস্থান করেন। সেই সুযোগে চলতি বছরের মে মাসে পুরনো ভবনটি গুঁড়িয়ে দিয়ে দখলে নেন হাজী সেলিম। চারপাশে সীমানা প্রাচীরও দিয়ে ফেলেন রাতারাতি। গত সোমবার রাতে সীমানা প্রাচীরের গেটের তালা ভেঙে তা দখলে নেয় ব্যাংক।

লালবাগ থানা এলাকায় অবস্থিত ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুলের এক একর জমি দখল করার অভিযোগও রয়েছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। সংস্থাটির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার প্রধান প্রকল্পের অনুকূলে সরকার ওই জমি স্কুলকে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করে অনুমোদন দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাজী সেলিম ওই জায়গা জবরদখল করেছেন। আদালতও আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু এর পরও হাজী সেলিমের কারণে আমরা দখলে যেতে পারিনি।

চকবাজারের ছোটকাটারায় বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে হাজী সেলিমের চাঁন সরদার কোল্ড স্টোরেজ। তবে বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছেন কোল্ড স্টোরেজের জায়গাটি একাধিক মালিকের কাছ থেকে জোর করে দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। ওই জমির মধ্যে সাত কাঠা জমির মালিক বলে দাবি করেন পুরান ঢাকার হাজী বদিউজ্জামান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, জমির সকল প্রকার কাগজপত্র আমাদের নামে। এর পরও জায়গাটি জবরদস্তি দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। বিভিন্ন সময় আমরা জমিটি উদ্ধারের চেষ্টা করলেও হুমকি-ধমকির কারণে শেষ পর্যন্ত পারিনি। হাজী বদিউজ্জামান সরকারের কাছে অনুরোধ রেখেছেন, জমিটি যেন সঠিক মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, ভয়ে কেউই মুখ খুলছে না। চাঁন সরদার কোল্ড স্টোরেজ ও এর আশপাশের সব জায়গায়ই জোর করে দখলে নিয়েছেন হাজী সেলিম। আমরা যুগ যুগ ধরে আওয়ামী লীগ করি। কিন্তু হাজী সেলিম আওয়ামী লীগে যোগদানের পর থেকেই অত্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। অব্যবহৃত জমি পেলেই দখলে নিচ্ছেন।

পুরান ঢাকার চাঁন সরদার কোল্ড স্টোরেজ। ২০০১ সালের দিকে এই কোল্ড স্টোরেজ তৈরির সময়ে স্থানীয় আবদুর রহমানের দুই কাঠা জমি দখলে নেন হাজী সেলিম। এরপর বিভিন্ন সময়ে ওই জমি উদ্ধারে চেষ্টা করেছিলেন আবদুর রহমান। কিন্তু সফল হননি। এ বিষয়ে আবদুর রহমান বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে হাজী সাহেবের (হাজী সেলিম) সঙ্গে বসেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। জমিটি উদ্ধার করতে পারিনি।

স্থানীয় বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, পুরান ঢাকার জামিল স্টোরের ৫ কাঠা জমি, মদিনা আশিক টাওয়ার ও জাপান ইলেক্ট্রনিক্সের জায়গা দখল করেছেন হাজী সেলিম।

চকবাজার এলাকার নলগোলা সর্দার হার্ডওয়্যার মার্কেটটি ভাওয়াল এস্টেটের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এটিও দখলে নিয়েছেন হাজী সেলিম। যদিও এ নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে। একই দশা চকবাজারের বশির মার্কেটের। মার্কেটটি গত বছর কোরবানির ঈদের রাতে হঠাৎ করেই ভেঙে ফেলেন হাজী সেলিম এবং নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। পুরান ঢাকার ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট, মনসুর খান প্লাজা ও হারিকেন মার্কেটও দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। যদিও ভুক্তভোগীরা এ নিয়ে মুখ খুলতেও ভয় পাচ্ছেন।

কেবল সাধারণ মানুষের জমি, ওয়াকফ সম্পত্তি আর বধিরদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাই নয়, ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিব্বত হলও দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। সেখানে গড়ে তুলেছেন তার স্ত্রীর নামে একটি মার্কেট, গুলশান আরা সিটি।

জানা যায়, পাটুয়াটুলী ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯নং জিএল পার্থ লেনের প্রায় ৯ কাঠার হলটি দখল করেছেন হাজী সেলিম। ২০০১ সালে হলটির স্থানে স্ত্রীর নামে গুলশান আরা সিটি মার্কেট নির্মাণ করেন তিনি। প্রতিবাদে কয়েক দফা আন্দোলনও করেন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা। তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। জানা যায়, নব্বইয়ের দশকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে স্থানীয়রা হলটির দোতলায় আগুন দিলে তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. হাবিবুর রহমান নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত ‘তিব্বত হল’ লেখা সাইনবোর্ড থাকলেও শিক্ষার্থীরা আর হলটিতে ফিরে যেতে পারেনি।

এদিকে, ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের রয়েছে ১২ জনের ক্যাডার বাহিনী, যাদের মাধ্যমে এলাকায় চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক আধিপত্য ও দখলের রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।

ক্যাডার বাহিনীর সঙ্গে গোপন যোগাযোগের জন্য তার বাসায় স্থাপন করেছিলেন কন্ট্রোল রুম। এর অ্যান্টিনা ছিল বাসা থেকে হাঁটা দূরত্বে মদিনা আশিক টাওয়ারের ১৭তলা ভবনের ছাদে।

কন্ট্রোল রুমটিতে সিসি ক্যামেরার মনিটরসহ একটি ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি ডিভাইস) ছিল, যেটার সঙ্গে যুক্ত ছিল ৩৮টি ওয়াকিটকি।

র‍্যাবের অভিযান সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছেন, ইরফান তার এই সশস্ত্র ১২ ক্যাডার নিয়ে এলাকায় চলাফেরা করতেন। এলাকার দখল ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে মদিনা আশিক টাওয়ারের ছাদে স্থাপন করেছিলেন টর্চার সেল।

ইরফানের ১২ সদস্যের ক্যাডারসহ নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও এলাকা নিয়ন্ত্রণে হাজী সেলিম পরিবারের রয়েছে ৩৫ জনের ক্যাডার বাহিনী।

কন্ট্রোল রুমটি দুই থেকে তিন বছর আগে স্থাপন করেন ইরফান। তিনি ঢাকা দক্ষিণের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার আগ থেকেই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্যাডারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

ভিএইচএফ ডিভাইসটির মাধ্যমে চার কিলোমিটারের বেশি এলাকা জুড়ে ইরফান তার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। ভিএইচএফ ব্যবহারের কারণে পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের এই যোগাযোগ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারত না। এই প্রযুক্তি দেশের বাইরে থেকে অবৈধভাবে আনা হয়েছিল, যা ব্যবহার করে ইরফান তার সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে হাজী সেলিমের মদিনা টাওয়ারের এক সাধারণ জুয়েলারি ব্যবসায়ী  বলেন, এই চকবাজার এলাকায় সেলিম ও তার পরিবারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই। আমরা তার ভবনে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করি। কিন্তু আমাদের সঙ্গেও তার লোকেরা যে আচরণ করে তা বলার মতো না। শুধু তার ভবনেই না, আশেপাশের মার্কেট আর ভবনের ব্যবসায়ীদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয় তার লোকদের। নইলে এই ভবনের অনেককেই ওপরে নিয়ে যাওয়া হতো। এতদিন শুধু গুজব শুনতাম যে ওপরে যাদের নেওয়া হয় তাদের শায়েস্তা করা হয়। আজ জানলাম সেখানে টর্চার সেল রয়েছে। তার বাসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেটের এসবের আশেপাশে সরকারি সড়কে কেউ গাড়ি পার্ক করতে পারে না, বাইক রাখতে পারে না। আমাদের গ্রাহকেরা এসব মার্কেটে এসে তার লোকদের কাছে হয়রানির শিকার হয়।

র‍্যাব কর্মকর্তা জানান, প্রতি রাতে মাতাল হয়ে ইফরান ও তার সহযোগীরা রাস্তায় বের হতেন এবং ক্ষমতার প্রদর্শন করতেন। তার ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে স্থানীয়রা কিছু বলার সাহস পায়নি। তবে এখন অনেকে কথা বলছেন।

পাত্তা দিতেন না প্রশাসনকে,মই কি হনুরে ভাব নিয়ে চলতেন।

ইরফানের টর্চার সেল ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য ছিল না। র‍্যাবের অভিযানের পরই আমরা জানতে পেরেছি।’

র‍্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানিয়েছেন, সোমবার তাদের অভিযানের পর ইরফান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ র‍্যাবের কাছে আসছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে ইরফান ও জাহিদের এক বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের জন্য আরও দুটি মামলা হবে।’

নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে প্রথমে আঘাত করেন জাহিদ

নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ খানকে প্রথম মারধর শুরু করেন সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের দেহরক্ষী জাহিদুল ইসলাম জাহিদ। এরপর গাড়ি থেকে নেমে আসেন ইরফান, চালক মিজানুর রহমান এবং মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু। তারাও ওয়াসিফকে মারধর ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন।

ধানমন্ডি থানা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন এবি সিদ্দিক দিপু।

সোমবার মধ্যরাতে টাঙ্গাইল থেকে তাকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশের রমনা বিভাগ। মঙ্গলবার দিপুকে তিন দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ।

নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফকে হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আশফাক রাজীব হাসান বলেন, মূল আসামিসহ চারজনই গ্রেফতার আছে। দুইজন অন্য অপরাধে কারাগারে। তাদেরও রিমান্ডের আবেদন করেছি। বাকি দুজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে কলাবাগান সিগন্যাল সংলগ্ন স্থানে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ মারধরের শিকার হন। অভিযোগ ওঠে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। প্রথমে ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি ও পরদিন সোমবার ইরফান সেলিমসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন ওয়াসিফ।

ঘটনার ৩২ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ, র‍্যাব ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে।

রোববার সন্ধ্যায় ওই ঘটনার পর হাজী সেলিমের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ ১১-৫৭৩৬) জব্দ করা হয় এবং রাতেই গাড়ির চালক মিজানুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মিজানুরকে সোমবার আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত এক দিন মঞ্জুর করে।

সোমবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনে হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালায় র‍্যাব। সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিট, র‍্যাব-৩ ও ১০ অভিযানে অংশ নেয়। সঙ্গে ছিলেন দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

অস্ত্র, মাদক, অবৈধ ওয়াকিটকিসহ ইরফান সেলিম ও তার সহযোগী জাহিদকে গ্রেফতার করে র‍্যাব। মাদক ও ওয়াকিটকি ব্যবহারের অপরাধে দুজনকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার মধ্যরাতে তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

মামলায় আরেক আসামী এবি সিদ্দিক দিপুকে সোমবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে টাঙ্গাইল থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। মঙ্গলবার তাকে তিন দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ।

ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকরাম আলী মিয়া বলেন, মামলার এজাহারে উল্লেখ থাকা চারজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও কাউকে জড়িত পাওয়া গেলে আইনাননুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সোমবার অভিযানের সময় অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখার অপরাধে ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার রাতে আরও দুটি করে মোট চারটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র‍্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।