ঢাকা রবিবার, ১১ই মে ২০২৫, ২৮শে বৈশাখ ১৪৩২


ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৫০ শতাংশ : ক্যাব

চতুর্মুখী চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ


৮ জানুয়ারী ২০২০ ২১:৫৩

আপডেট:
৮ জানুয়ারী ২০২০ ২২:০১

বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮ শতাংশের বেশি। আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭১ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। গৃহস্থালি গ্যাসের দাম বেড়েছে ২১ শতাংশের ওপরে। মসলাজাতীয় পণ্যের কোনোটিতে বেড়েছে ৪৪ শতাংশ, কোনোটিতে ৪০ শতাংশ। সবজি জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে কোনোটির ৫২ শতাংশ, কোনোটির ৩০ শতাংশ। মুরগির দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ আবার তরল দুধের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের ওপরে।

এভাবে গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে অধিকাংশ পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও সেবা-সার্ভিসের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে চতুর্মুখি চাপে পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা দশা সাধারণ মানুষের।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ‘জীবনযাত্রার ব্যয় ও ভোক্তা-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর প্রতিবেদনে’ এসব তথ্য প্রকাশ করে। বিদায়ী ২০১৯ সালের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির এ তথ্য তুলে ধরেন ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান।

লিখিত বক্তব্যের পর বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত এক বছরে ধনী লোকের বাড়িভাড়া না বাড়লেও গরিবের বাড়িভাড়া বেড়েছে। সরকার পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে এবং যারা পেঁয়াজ কারসাজির সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তিও দিতে পারেনি।

তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখে, ভোক্তার নয়। এ জন্য ‘স্বতন্ত্র ভোক্তা বিষয়ক’ মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। তা ছাড়া এখন আর নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। ক্যাব সভাপতি মনে করেন, নতুন বছরও শুরু হয়েছে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অশনিসংকেত দিয়ে।

গত বছর রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবার তথ্য পর্যালোচনা করে ক্যাব এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলে জানান তিনি।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ২০১৯ সালে পেঁয়াজ, এলাচি, রসুন ও আদা ছাড়া অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বহুলাংশে স্থিতিশীল ছিল। চালের দাম ছিল সহনীয় ও নিম্নমুখী। তবে বছরের শেষে চাল, আটা, ডিম, শাক-সবজিসহ কিছু পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভোজ্য তেল, লবণ, চিনি, সাবান ও পান-সুপারি ইত্যাদি পণ্যের দাম কমেছে।
২০১৯ সালে পেঁয়াজ ছিল সর্বাধিক আলোচিত পণ্য। বছরের শুরুতে এর দাম ছিল প্রতিকেজি ২০-২৫ টাকা। নভেম্বর মাসে তা বেড়ে খুচরা বাজারে ২৫০ টাকারও বেশি বিক্রি হয়েছে। উৎপাদন মৌসুম শুরুর পরও ডিসেম্বর শেষে পেঁয়াজের দাম ছিল ১০০ টাকার কাছাকাছি। এ বছর দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭১ দশমিক ১১ শতাংশ। এলাচির দাম বেড়েছে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আদার দাম বেড়েছে ১২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। বিভিন্ন শাক-সবজির গড় দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেড়েছে পটোলের দাম, ৫২ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত ২০১৯ সালের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। পণ্য ও সেবামূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। এর আগে ২০১৮ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৬ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।

বছরের শুরুতে শাক-সবজির দাম স্বাভাবিক থাকলেও শেষদিকে বেশ চড়া দামেই কিনতে হয়েছে ভোক্তাদের। সারা বছর বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির মূল্য বেড়েছে গড়ে ৮.১৩ শতাংশ। শাক-সবজির পাশাপাশি বছর জুড়ে ভোক্তাকে মাছ, গুঁড়ো দুধ ও গরুর তরল দুধের পেছনেও বাড়তি খরচ করতে হয়েছে।

ক্যাবের প্রতিবেদনে বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির সমালোচনা করে বলা হয়, দেশের বাজারে পণ্যমূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এটা প্রত্যাশিত হলেও তা হচ্ছে না। উচ্চহারে আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে ২০১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে ভোক্তদের পণ্য ক্রয়ে ১৪২ কোটি ২৩ লাখ মার্কিন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে। বাংলাদেশে আমদানি শুল্কহার গড়ে ২৫.৬৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮ শতাংশ : নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। বস্তির ঘরভাড়া ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও মেসের ভাড়া বেড়েছে ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। বাসাবাড়িতে বার্নার গ্যাসের চুলার ব্যয় বেড়েছে ২১ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

তেলের দাম কমলেও পরিবহন ব্যয় কমেনি : হাইওয়ে সম্প্রসারণ এবং জ্বালানি তেলের মূল্য কমলেও যাত্রী ও পরিবহন ব্যয় কমেনি। ২০১৯ সালে রাজধানীতে যানজটের তীব্রতা বেড়েছে। তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সড়ক রেল ও নৌপথে ৪ হাজার ৮৯৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আগের বছরের তুলনায় সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ৫১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ছাত্রদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সড়ক নিরাপত্তা আইন পাস হয়। গত বছর এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে আইন বাস্তবায়নে শৈথিল্য দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবার ফি অনিয়ন্ত্রিত, ওষুধের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে : প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ঘটেছে। তবে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান। সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরাও ঘটা করে চিকিৎসার জন্য প্রায়ই বিদেশ যান। এতে স্পষ্ট যে, দেশের চিকিৎসা সেবার মান কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছায়নি। ওষুধ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ বিশে^র ১৪২টি দেশে ওষুধ রফতানি করে। কিন্তু দেশে ব্যাপকভাবে নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। কিছু ওষুধের উচ্চমূল্য দরিদ্র রোগীদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বেসরকারি খাতে ডাক্তারদের ফি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার ফি বহুলাংশে অনিয়ন্ত্রিত, কোনো ক্ষেত্রে অসন্তোষজনক।

অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সার্টিফিকেট প্রদানের কারখানা : শিক্ষা খাতে ঝরে পড়ার হার কমলেও অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ যা দিন দিন বাড়ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সার্টিফিকেট প্রদানের কারখানায় পরিণত হয়েছে। দেশে এখনও দুই কোটি মানুষ অতি দরিদ্র। এ ছাড়া বেশিরভাগ মানুষ হতদরিদ্র, নিম্নআয় ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের শ্রেণিভুক্ত। পণ্য মূল্যবৃদ্ধি তাদের জীবনমানে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

ভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি : সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের স্বার্থের দিক তুলে ধরতে ভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানায় ক্যাব। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গোলাম রহমান বলেন, কারণে-অকারণে মূল্যবৃদ্ধি করছে, তাদের খুঁজে দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দেশে চালের দাম বাড়ছে আর কৃষক ধানের দাম পায় না। এই দ্রব্যমূল্যের ব্যয় সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেল : বিগত এক দশকে বিদ্যুতে অভাবনীয় উন্নতি হলেও বাড়তি ব্যয়ে চালানো কুইক রেন্টালগুলো সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচকে ঊর্ধ্বমুখী করে তুলছে। ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য সাতবার এবং খুচরা মূল্য ৯ বার বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের কাছে চড়া মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করা সত্ত্বেও উৎপাদন ও বিতরণ ব্যয় সংকুলান সম্ভব হচ্ছে না এমন অজুহাত তুলে আবারও মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম।