টাকার বস্তা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন এনু-রুপন

‘প্রতি রাতে বস্তা ভরে টাকা নিয়ে বাসায় ফিরত এনু, রশীদ ও রুপন। এসব টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে বাসাতেই রাখত। শোবার ঘরে খাটের নিচে রেখে দিত বস্তা ভরা টাকা’ এভাবেই পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া ও ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগ নেতা তিন সহোদর এনামুল হক এনু, রুপন ভূঁইয়া ও রশীদ ভূঁইয়া বাসায় টাকা নেওয়ার বর্ণনা দেন তাদের বাসার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহকর্মী। তার ভাষ্য, তাদের বাসার টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারের এক আনাও উদ্ধার করতে পারেনি র্যাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, ‘এনামুল হক এনু, তার ভাই রুপন ভূঁইয়া, বন্ধু হারুন অর রশীদ এবং কর্মচারী আবুল কালাম আজাদের বাসায় অভিযানের পর বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই থানায় ছয়টি মামলা করা হয়েছে। মামলার কাগজপত্র তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কাজে আমাদের ব্যস্ত সময় কেটেছে। এ কারণে আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান করা যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটু সময় দেন, এসবের সঙ্গে যারাই জড়িত সবাইকে ধরে ফেলব।’
র্যাবের আরেক কর্মকর্তা বলেন, জুয়া, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ওয়ারী, যাত্রাবাড়ী, গেণ্ডারিয়া, সূত্রাপুর, বংশাল, কোতোয়ালিসহ আশপাশ বিভিন্ন থানার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের আরও প্রায় দেড় ডজন নেতার তথ্য সংগ্রহ করছেন। অভিযানের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘রশীদ ভূঁইয়া, এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। তারা নিজেরাও আন্ডারওয়ার্ল্ডেরই লোক। তারা একসময় পুরান ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদের সহযোগী ছিলেন। ২০১২ সালের জুন মাসে বন্দুকযুদ্ধে ডাকাত শহীদ নিহত হওয়ার পর তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দখল নেন এনু-রশীদ। এরপর আর তাদের পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ডাকাত শহীদের লোক হিসেবে তারা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবেরও দখল নেন। জুয়া ব্যবসার পাশাপাশি তারা দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক হারে সুদে টাকা খাটান। প্রতি ১ লাখ টাকায় তারা এক মাসের জন্য সুদ নেন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। সপ্তাহ হিসেবে তারা সুদ নিতেন প্রতি লাখে ৩ হাজার টাকা করে। এভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা।’ ওই নেতা আরও বলেন, ‘রশীদ, এনু বা রুপন তিন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কাউন্সিলর হলে তাদের দখল-অবৈধ আয় আরও কয়েকগুণ বাড়ত।’
মুরগিটোলার মুদি দোকানদার খোকন মিয়া বলেন, ‘এনু-রশীদরা জুয়া ও সুদের কারবারের মাধ্যমে যেসব টাকা পেতেন তারা সেগুলো দিয়ে জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও সোনার অলংকার কিনতেন। অনেক দামে এসব বাড়ি কিনলেও রেজিস্ট্রেশন করতেন অল্প টাকায়। যাতে সহজেই কর ফাঁকি দিতে পারেন।’
এনু-রশীদদের ক্ষমতার উৎস কোথায় জানতে চাইলে ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, “এদের ক্ষমতার মূল উৎস টাকা। টাকা দিয়ে এরা সব জায়গায় ‘ম্যানেজ’ করে রাখতেন। থানা পুলিশ-ডিবি এদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নিত। ডাকাত শহীদের পর এনু-রশীদ তার সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেন। সেখান থেকেই তারা বিপুল টাকার মালিক হন।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এনু-রুপন ও রশীদের বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ। এই সিরাজ একসময় ভবঘুরে ছিলেন। তবে জুয়া খেলার নেশা ছিল। বিভিন্ন স্থানে জুয়ার বোর্ড চালাতেন তিনি। বাবার দেখানো পথেই জুয়ার কারবারে নামেন তিন ছেলে। সূত্রাপুর-গেণ্ডারিয়া এলাকায় তারা ‘জুয়াড়ি পরিবার’ হিসেবেই পরিচিত।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এনু-রুপন এলাকাতেও ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে জুয়ার আসর বসিয়েছেন। যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তারের পর সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। এনু ইতিমধ্যে থাইল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছেন। রুপন-রশীদসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা গা ঢাকা দিয়েছেন।
বানিয়ানগর মুরগিটোলার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, বছর পাঁচেক আগে গেণ্ডারিয়ার দক্ষিণ মৈসুন্দী এলাকার টিনশেডের একটি বাড়িতে থাকত সিরাজ ভূঁইয়ার পরিবার। সেখান থেকে তারা গেণ্ডারিয়া, সূত্রাপুর এবং ওয়ারীসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কমপক্ষে ১৫টি বহুতল বাড়ি ও অন্তত ৫০টি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। ভূঁইয়া পরিবারের সদস্যরা আটটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। এসব গাড়িতে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের লোগো লাগিয়ে ঘোরাফেরা করেন তারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত মঙ্গলবারের অভিযানের পরপরই পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া ও নারিন্দায় এনু-রুপনদের বাড়িগুলোর হোল্ডিং নম্বর তুলে ফেলা হয়। এগুলোর বেশ কয়েকটি নির্মাণাধীন ও কয়েকটি শেষ হয়েছে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে। কোনোটি ছয়তলা, কোনো কোনোটি ১০ তলা বাড়ি। বানিয়ানগর, মুরগিটোলা, দয়াগঞ্জ নতুন রাস্তার মোড়ে তাদের ছয়তলা বাড়ি আছে। নতুন বাড়িটির প্রথম তিনতলা রুপনের, পরের তিনতলা এনুর।
দামি আসবাবে ঘর সাজানো হলেও তারা কেউই সেখানে থাকেন না। তারা থাকেন পুরান ঢাকার লালমোহন সাহা স্ট্রিটের ১০৬ নম্বর হোল্ডিংয়ের ‘মমতাজ ভিলায়’। সেখানে গিয়েও প্রধান ফটক তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। ভজহরী সাহা স্ট্রিটেও এনু ও রুপনদের একটি বাড়ি আছে। এছাড়া নন্দলালের গলির ধোপাপট্টিতে একটি, দক্ষিণ মৈসুন্দীতে একটি, সাহেব লেনে একটি, বানিয়ানগরে দুটি, শরৎচন্দ্র রোডে একটিসহ আরও বিভিন্ন জায়গায় তাদের বাড়ি আছে।
টাকা দিয়ে দলীয় পদ : এনু গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তার ছোট ভাই রুপন একই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বড় ভাই রাশিদুল হক রশীদ ভূঁইয়া ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। রশীদ ভূঁইয়ার ছেলে বাতেনুল হক বাঁধন ভূঁইয়া ওয়ারী থানায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, রশীদের ভাতিজা তামিম ভূঁইয়া একই কমিটির সহসভাপতি।
এছাড়া ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ পাভেল গেণ্ডারিয়া থানার ৪০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি, আবদুর রাজ্জাক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক ও এনুর বন্ধু হারুন-অর-রশিদ ওয়ার্ড যুবলীগের কার্যকরী সদস্য। তাদের পরিবারের আরেক সদস্য মজিবুর রহমান গেণ্ডারিয়া আওয়ামী লীগের সদস্য।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘পরিবারের নয় সদস্যের বাইরে রশীদ, এনু ও রুপনের ক্যাসিনোসহ নানা অপকর্মের দেখভালকারী অন্তত ১০ জন আছেন বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিটিতে। তারা রাজনীতি করেন না। অবৈধ ক্যাসিনোসহ নানা অপকর্ম করার জন্য তাদের দলের পদে বসানো হয়েছে।
আগে কোনো কমিটিতে না থাকলেও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলনে তাদের পদ দেওয়া হয়। গেণ্ডারিয়া থানা থেকে পাঠানো তালিকায় নাম না থাকলেও মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতাকে কোটি টাকা দিয়ে এসব পদ বাগিয়ে নেওয়া হয়েছে।’
আরেক নেতা বলেন, সিরাজ ভূঁইয়ার পরিবার আগে থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল না, পদ-পদবিও ছিল না। তারা বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন নেতাকে টাকা দিয়ে জুয়ার আসর চালাত। দেশের বিভিন্ন মেলায়ও তাদের লোকজন টাকা দিয়ে জুয়ার আসর পরিচালনা করে।
ব্যবসার খবর জানে না এলাকাবাসী : সিরাজ ভূঁইয়ার পরিবারের সদস্যরা এলাকায় নিজেদের এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু তারা কী ধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করেন এলাকার কেউই সেটা জানে না। সরেজমিনে ২৯ বানিয়ানগরে ‘এনু রুপন স্টিল হাউস’ নামে একটি সাইনবোর্ড টানানো দেখা গেছে। এর বাইরে তাদের কোনো বৈধ ব্যবসার তথ্য জানে না এলাকাবাসী।
সুদের কারবার : ইসলামপুর, বাবুবাজার, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের চড়া সুধে ঋণ দিতেন রশীদ ও এনু। জুয়ার কারবারের পাশাপাশি চড়া সুদের কারবার করতেন তারা। বাবুবাজারের ব্যবসায়ী নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, এনুর কাছ থেকে মাসে ৫ হাজার টাকা চক্রবৃদ্ধি সুদে ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন। আসল না নিলেও নিয়মিতভাবে তারা সুদের টাকা আদায় করে নেন। এনুর ভাই রশীদও সুদের কারবারি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
অস্ত্র ও ক্যাডার বাহিনী : এনুর বাসায় অভিযানের সময় শটগান-পিস্তলসহ ছয়টি অস্ত্র উদ্ধার হয়। তাদের বাহিনীর কাছে আরও বেশকিছু অস্ত্র রয়েছে বলে জানা গেছে। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে জমি লিখে নেওয়ার অভিযোগও আছে। স্থানীয়রা বলছেন, তার বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত এলাকায় গাড়ির হর্ন বাজিয়ে মহড়া দিয়ে থাকে।
থানায় মামলা : গত মঙ্গলবার এনু, রুপন, তাদের কর্মচারী আবুল কালাম এবং বন্ধুর বাসায় র্যাব অভিযান চালিয়ে ৫ কোটি টাকা, ৮ কেজি স্বর্ণ, ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনে বুধবার রাতে দুটি মামলা হয়েছে। এছাড়া সূত্রাপুর থানায় বৃহস্পতিবার অস্ত্র, মানি লন্ডারিং, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বিভিন্ন ধারায় আরও চারটি মামলা করা হয়।
মামলাগুলো থানা পুলিশই তদন্ত করছে। পরে মামলাগুলো পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) ন্যস্ত করা হতে পারে। এছাড়া কয়েকটি মামলা র্যাবও তদন্ত করার কথা রয়েছে।
দেড় ডজন নেতা নজরদারিতে : ক্যাসিনো পরিচালনা, জুয়ার কারবার ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করা পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের দেড় ডজন নেতার তথ্য সংগ্রহ করেছে র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইং। এছাড়া সরকারের আরও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। কাদের নামে তদন্ত চলছে জানতে চাইলে র্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তা জানাতে রাজি হননি।