দেবর-ভাবিতে দলের বারোটা

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর আগেই দলের ভেতর ও বাইরে আশঙ্কা করা হয়েছিল তার অবর্তমানে জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতৃত্বে সংকট দেখা দেবে। এরশাদের জীবদ্দশায় দলের ভেতরকার নানা দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে পড়বেন দলের শীর্ষ নেতারা। কেউ কারও নেতৃত্ব মানবেন না। বিশেষ করে এরশাদের স্ত্রী, দলের কো-চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ এবং এরশাদের ভাই দলের চেয়ারম্যান (বেঁচে থাকতেই এরশাদ ঘোষিত) জিএম কাদেরের মধ্যকার দীর্ঘদিনের বিরোধ কীভাবে সমাধান হবে এ নিয়ে চিন্তা ছিল সবচেয়ে বেশি। এরশাদের মৃত্যুর ১ মাস ২০ দিনের মাথায় এসব আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের দুজন প্রেসিডিয়াম মেম্বার বলেন, এই মুহূর্তে তিন ধরনের সংকটের মুখে জাপা। এরশাদের মৃত্যুর মাত্র চার দিনের মাথায় জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধের নিষ্পত্তি না হতেই আরও দুই সংকট এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। এর মধ্যে একটি হলো কে হবেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং অন্যটি হলো এরশাদের শূন্য রংপুর-৩ আসনে কে পাবেন পার্টির মনোনয়ন। দলের চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে কাদের ও রওশনপন্থি দুই গ্রুপের বিরোধের মধ্যে এবার রংপুর-৩ আসনের মনোনয়ন নিয়ে নতুন করে বিরোধ সৃষ্টি করেছেন রংপুরের নেতাকর্মীরা। তারা কিছুতেই এরশাদ-রওশন এরশাদ দম্পতির ছেলে সাদ এরশাদকে সেখানকার মনোনয়ন দিতে রাজি নন। এ ব্যাপারে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ তারা।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সংকট সামাল দিয়ে ভবিষ্যতে দলের অবস্থা কী হবে জানতে চাইলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, পার্টিতে মূল দ্বন্দ্ব জিএম কাদের ও ম্যাডামের (রওশন এরশাদ) মধ্যে। তাদের মধ্যে সমঝোতা হলেই বর্তমানে যেসব বিষয় ঘিরে সংকট চলছে, সেগুলোর সমাধান হবে। এ দুজনের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে যে দ্বন্দ্ব, সেটার সমাধান হলে দলের ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে। আমরা আশা করি এটা ঠিক হয়ে যাবে।
এই নেতা আরও বলেন, জাতীয় পার্টি টিকিয়ে রাখতে হলে এরশাদ স্যারের পরিবারের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের হাতেই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দিতে হবে। এর বাইরে অন্যকিছু ভাবা যাবে না। তারা দুজন যদি মিলে যায়, তা হলে জাতীয় পার্টি তার আগের অবস্থানেই থাকবে। ভবিষ্যতে আর কোনো সংকট দেখা দেবে না। দুজনকেই পার্টির গঠনতন্ত্র মানতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতীয় রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি এখন ফ্যাক্টর। সুতরাং সে অবস্থান ধরে রাখতে হলে নিজেদের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে হবে।
দলের নেতাদের মতে, এরশাদ নানা কৌশলে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছিলেন। সব নির্বাচনেই ভোটের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নেয় জাপা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতার রাজনীতির জন্য এরশাদের জাপা ছিল
গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। এখনো জাপার গুরুত্ব আছে। কিন্তু এরশাদবিহীন জাপা ভবিষ্যতে ঠিক কোন অবস্থান নেবে, এ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তারা।
বিরোধীদলীয় নেতা হতে পাল্টাপাল্টি চিঠি : সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকারের কাছে পাল্টপাল্টি দুটি চিঠি দিয়েছে জাপা। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য চিঠি দেওয়ার এক দিন পর গতকাল বুধবার স্পিকারকে পাল্টা চিঠি দিয়েছেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। তাতে জিএম কাদেরের চিঠি গ্রহণ না করার অনুরোধ করা হয়েছে।
তবে দুপক্ষ পাল্টাপাল্টি চিঠি দিলেও বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। গতকাল বুধবার স্পিকার সাংবাদিকদের বলেন, আমি মালদ্বীপে স্পিকারস সামিট থেকে সবে ফিরলাম। বিরোধীদলের পক্ষ থেকে দুটি চিঠি পাঠানোর কথা শুনেছি। চিঠি দেখে বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু দেশ রূপান্তরকে বলেন, জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য যে চিঠি দেওয়া হয়েছে তা আনুষ্ঠানিক নয়। কারণ জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের কোনো বৈঠক হয়নি। জিএম কাদেরের চিঠি গ্রহণ না করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এর আগে জিএম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করতে গত মঙ্গলবার স্পিকারকে দলের পক্ষ থেকে চিঠি দেন জিএম কাদের। সেদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সম্মতি নিয়েই তাকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে চিঠিটি পাঠানো হয়। দলের চেয়ারম্যান হিসেবে তার ভাই এরশাদ যেভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন, তিনিও সেভাবেই নিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা মনোনয়ন প্রশ্নে জোর করে কিছু করা হয়নি। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তবে স্পিকারকে দেওয়া জিএম কাদেরের চিঠির বিষয়ে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমি সাংসদ, আমি নিজেও জানি না এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে। রওশন এরশাদও জানেন না। তিনি বিরোধীদলীয় উপনেতা। এ কাজটি করে জিএম কাদের ঠিক করেননি।
এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে জিএম কাদের গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ফোনে সংসদ সদস্যদের জিজ্ঞেস করেছি। তারা সম্মতি দিয়েছে। লিখিত দিতে বলা হলে ১৫ জন সম্মতিপত্র দিয়েছে। ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন সম্মতি দিলে আর কিছু লাগে না। তাই অন্যদের বলা হয়নি। এখন আরও অনেকে দিতে চাচ্ছে। প্রয়োজন নেই বলে নেওয়া হচ্ছে না। এরশাদ সাহেব যখন বেঁচে ছিলেন, তিনিও কিন্তু এভাবে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন, আমাকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করেছিলেন। পরে আমাকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে উপনেতা করা হয়, তখনো কিন্তু পার্লামেন্টারি পার্টির কোনো মিটিং হয়নি।
স্পিকারকে চিঠি পাঠানোর আগে গতকাল গুলশানের বাড়িতে সভাপতিম-লীর কয়েক সদস্য ও সংসদ সদস্যকে নিয়ে আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন রওশন। ওই বৈঠকের পর জানানো হয়েছে, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন রওশন। এ ব্যাপারে চুন্নু দেশ রূপান্তরকে বলেন, আগামীকালের (আজ বৃহস্পতিবার) সংবাদ সম্মেলনের পর পরিষ্কার হওয়া যাবে সবকিছু।
সাদকে মানতে নারাজ রংপুর : এরশাদের শূন্য আসনে (রংপুর-৩) তার ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদকে ঠেকাতে এবার একাট্টা হয়েছেন রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির নেতারা। রাজনীতিতে ‘আনকোরা’ সাদকে ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে এসব নেতা এরশাদপুত্রের বিরোধিতা করছেন। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান এরশাদ মারা যাওয়ায় আগামী ৫ অক্টোবর রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পরই এরশাদের বড় ছেলে সাদ এরশাদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের কথা শোনা যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রংপুর মহানগরের নেতারা। গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে রংপুরের মেয়র এবং দলের মহানগর সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সভাপতিম-লীর সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তাফা বলেন, রংপুরের এই গুরুত্বপূর্ণ আসনে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা কোনো বহিরাগত প্রার্থীকে মেনে নিতে পারবে না। দলের নেতাকর্মীরা লোকাল প্রার্থী চান।
একই দিন জাপার মনোনয়ন প্রত্যাশী আরেক প্রার্থী ও এরশাদের ভাতিজা মকবুল শাহরিয়ার আসিফও তার সমর্থকদের নিয়ে সাদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন। আসিফের সমর্থকরা গত সোমবার রাতে রংপুর সদরে সাদ এরশাদের কুশপুত্তলিকা পোড়ায়। গতকাল বুধবারও এই দুইপক্ষ সাদবিরোধী মিছিল করেছে।
রংপুরের নেতাদের এই অসন্তোষের মধ্যেই গত মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকায় এসে দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন সাদ। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে সাদ বলেন, সব দলেই দ্বন্দ্ব থাকে। এটা কোনো বিষয় নয়।
এ ব্যাপারে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, কে মনোনয়ন পায় সেটা নির্ভর করবে বৃহস্পতিবারের (আজ) সংবাদ সম্মেলনের পর।
রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হতে ইতিমধ্যে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন দলের সভাপতিম-লীর সদস্য এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর, দলের যুগ্ম মহাসচিব এস এম ইয়াসির ও এরশাদের ভাগ্নি মেহেজেবুন্নেছা রহমান টুম্পা। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়া যাবে। আগামী শুক্রবার সকাল থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেবে জাপার পার্লামেন্টারি বোর্ড। জাতীয় পার্টির জন্মের পর থেকে রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টিই ভোটে জয়ী হয়ে আসছে।
কাদেরকে মানছেন না রওশন : এরশাদের মৃত্যুর চার দিনের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয় জিএম কাদেরকে। কিন্তু তা মানতে রাজি নন দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। গত ১৮ জুলাই জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পর বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রওশন এরশাদ বলেন, জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করার আগে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে জিএম কাদের এখনো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানই আছেন।
গত ১৪ জুলাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ। তার চার দিনের মাথায় এক সংবাদ সম্মেলনে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের নাম ঘোষণা করা হয়। এরশাদের স্ত্রী রওশন ওই সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থিত ছিলেন না। দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা সেদিন ওই ঘোষণা দিয়ে বলেন, মৃত্যুর আগে এরশাদই এ সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন।
এরপর গত ২০ জুলাই শনিবার এরশাদের বড় ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে গুলশান-২ নম্বরে ভাবি রওশনের বাসায় যান জিএম কাদের। রওশন সেদিন পার্টির নতুন চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে আশীর্বাদ করেন বলে দলের প্রেস সচিব সুনীল শুভ রায় সাংবাদিকদের জানান। কিন্তু দুই দিনের মাথায় রওশনের স্বাক্ষরে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় উল্টো কথা।
পরে অবশ্য রওশন এরশাদের ওই হাতে লেখা চিঠির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জিএম কাদের। তিনি বলেন, এই হাতে লেখা বিবৃতিটি কাঁচা, এটা বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাদের পরিবারে পিতৃতুল্য ছিলেন, সেইভাবেই বেগম রওশন এরশাদ আমাদের মায়ের মতো। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশনায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছি। এখনো পল্লীবন্ধুর নির্দেশনাতেই চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছি।