শরীরে এখনো ২৭৬ ছররা গুলি নিয়ে ধুঁকছেন জুলাইযোদ্ধা রেজা

চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন রাজধানীর সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’র শিক্ষার্থী মোঃ আরিফুল ইসলাম রেজা। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। শরীরে এখনো রয়েছে ২৭৬টি ছররা গুলি। বারবার চিকিৎসা ও সহায়তা চেয়েও তিনি হয়েছেন উপেক্ষিত। এমনকি তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়াও তার পাশে দাঁড়ায়নি।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলন চলাকালে সম্মুখ সারিতে ছিলেন আরিফুল ইসলাম রেজা। ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তিনি। আন্দোলনের প্রথম দিকে তিনি আলিম পরীক্ষার্থী (এইচএসসি) সরাসরি মাঠে থাকার সুযোগ না পেলেও, ১৬ই জুলাই পরীক্ষার পরপরই তামিরুল মিল্লাত কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভে যুক্ত হন। এরপর ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু সেদিনই ঘটে যায় জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা।
রেজা বলেন, এদিন যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হই। গুলি লাগার সাথে সাথে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। অন্য শিক্ষার্থীরা আমাকে কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এসময় আমার মোবাইলটি হারিয়ে যায়।
তিনি জানান, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকেরা তার পরিবারের খোঁজ নিতে চাইলে তিনি কিছু বলতে পারেননি। পরে অনেক কষ্টে নিজের বড় ভাইয়ের নাম্বার বলে অবস্থান জানান দেন। তাকে যাত্রাবাড়ীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশন করা হয়। এরপর ১৯ জুলাই জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়। চিকিৎসার মাঝেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি কথা বলতে পারতাম না, উঠতে পারতাম না, তারপরও দিনে তিনবার পুলিশ এসে ছবি তোলে, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত কিনা জানতে চায়। আমি কোনো সংগঠন বা দল করিনা, বিষয়টি পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার জানানো সত্ত্বেও তাদের সন্দেহের চোখে তাকানো থামেনি।
রেজা বলেন, ৩ আগস্ট আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এরপর জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে গেলেও ভর্তি নেওয়া হয়নি। হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে দুইদিন চিকিৎসা নিই। এরপর ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ হামলার খবর পেয়ে গেলে রাতেই পালিয়ে গাজীপুর চলে যাই। পরে ৫ আগস্ট দেশজুড়ে উত্তেজনা, গুজব চলমান। সেনাপ্রধানের ভাষণ, প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগের খবর। একসময় আমি অসুস্থ শরীরেই রাস্তায় গিয়ে দেখি বিজয় মিছিল। খুশিতে একঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারপর আবার অজ্ঞান হয়ে যাই।
আরিফুল ইসলাম রেজা বলেন, ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেল এবং সিএমএইচ-এ চিকিৎসা নিলেও কোনো স্থায়ী সমাধান মেলেনি। ডান হাতে এখনো শক্তি নেই, হাত অবশ হয়ে যায়, প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া হয়।
চিকিৎসক ও সহানুভূতিশীল মানুষেরা পাশে দাঁড়ালেও, কিছু কষ্ট রয়েই গেছে রেজার। তিনি বলেন, আমি যে প্রতিষ্ঠানে পড়ি—সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা—সেখান থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। ঢাকা আলিয়ার স্যারদের ও অধ্যক্ষকে জানালেও কোনো সহযোগিতার আশ্বাস পাইনি। কিন্তু জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন আমার পাশে দাঁড়িয়েছে এবং এক লক্ষ টাকা চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছে।
আরিফুল ইসলাম রেজা এখন উন্নত চিকিৎসার অপেক্ষায় রয়েছেন, এজন্য হয়ত কোনো সহানুভূতি বা সহায়তার হাত কাজে আসতে পারে। বেদনামাখা কণ্ঠে প্রতিবাদের ভাষায় তিনি বলেন, আমি কোনো অপরাধ করিনি, দেশের শিক্ষার্থীদের অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলাম, তার শাস্তি এতটা নির্মম হবে বুঝিনি।