ঢাকা শনিবার, ১০ই মে ২০২৫, ২৮শে বৈশাখ ১৪৩২


একঘরে হয়ে পড়ছেন নাছির


১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৯:৩৯

আপডেট:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২২:০৩

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে বাদ দিয়ে রেজাউল করিম চৌধুরীকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেওয়ায় পাল্টে গেছে নগরীর রাজনীতির চিত্রপট।

এত দিন যারা নাছিরের অনুসারী ছিলেন, বাড়ি-কার্যালয়ে ভিড় জমাতেন, সুবিধা নিতেন; তাদের অনেকেই তার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।

সবমিলে চসিকের প্রভাবশালী মেয়র হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে এখন যেন একঘরে হয়ে পড়েছেন।

গত দুদিন মেয়র হিসেবে চট্টগ্রামে অনেকটা একাই চলাফেরা করতে দেখা গেছে তাকে।

আর দলের মনোনয়ন পাওয়া চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীকে নগরীর সর্বস্তরের নেতাকর্মী মেয়র হিসেবে ধরে নিয়েছেন।

তারা ভিড় করছেন তার বাড়ি ও অফিসে ভবনে। যেন প্রভাবশালী নেতা হয়ে গেছেন তিনি। চসিকের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া রেজাউল করিম ছিলেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী।

সে অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চের নির্বাচনে তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের বড় সমর্থন পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে চসিকের মেয়র পদে রেজাউল করিম চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

রেজাউল করিম বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ কমিটিরই সাধারণ সম্পাদক বর্তমান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

তাকে বাদ দিয়ে ‘চমক হিসেবে’ রেজাউল করিমকে একক মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঢাকায় সৌজন্য সাক্ষাৎ করছেন ষাট দশকের ছাত্রলীগ তো রেজাউল করিম চৌধুরী।

এখনো তিনি চট্টগ্রামেই আসেননি। তবে আওয়ামী লীগের একশ্রেণির সুবিধাবাদী নেতাকর্মী মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে তার কাছে ধরনা দেওয়ার চেষ্টায় আছেন।

অনেকে ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে রেজাউল করিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

অথচ এসব নেতাকর্মীর অনেকের সঙ্গে তার আগে তেমন সখ্যও ছিল না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আওয়ামী লীগ নেতা  জানিয়েছেন, মূলত রেজাউল করিম চৌধুরী চসিকের মেয়র হলে যাতে নানাভাবে সুবিধা নেওয়া যায় সেই লক্ষ্যে সুবিধাভোগী যেসব নেতাকর্মী আছে, তারাই এখন তার কাছে ধরনা দিচ্ছেন।

ফেইসবুকে তার প্রশংসা করে ছবিযুক্ত পোস্টও দিচ্ছেন।

চট্টগ্রামের স্থানীয় নেতারা  জানান, আ জ ম নাছির মুখে মুখে প্রভাবশালী বললেও সংগঠন ও কর্মীদের জন্য গত সময়গুলোতে কিছুই করেননি।

মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ব্যবসাই করেছেন।

ফলে মেয়র পদে মনোনয়ন না পেলেও চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ, অসন্তোষ নেই। বরং সবার ভেতরে সন্তুষ্টি কাজ করছে।

চট্টগ্রামের সাবেক এক ছাত্র নেতা  বলেন, ‘গ্রুপ রাজনীতিটাই করেছেন নাছির।

একটা বিশেষ গ্রুপকে সবসময়ই সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এসেছেন। আর প্রতিপক্ষ রাজনীতিক গ্রুপকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি।

ফলে মনোনয়ন না পাওয়ার পরপরই একঘরে হয়ে গেছেন মেয়র নাছির।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে, যার বাড়ি চট্টগ্রামে।  তিনি বলেন, ‘মেয়র হিসেবে নাছির মনোনয়ন না পাওয়ায় চট্টগ্রামের রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

নাছির মেয়র ছিলেন ঠিকই। কিন্তু ৫ বছর ব্যবসা-বাণিজ্যই করেছেন।

নিজের বাহিনীর বাইরে কারও দিকেই নজর ছিল না তার। ফলে বন্দরনগরীর রাজনীতির অভিভাবকখ্যাত আ জ ম নাছির মনোনয়নবঞ্চিত হয়েই “জিরো” হয়ে গেছেন চট্টগ্রামে রাজনীতিতে।

’ তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে রেজাউল করিম রাজনৈতিক কোনো ভিত্তি না থাকলেও চট্টগ্রামে নাছিরবিরোধী অবস্থান এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তাই সবাই নৌকার প্রার্থীর পেছনে ভিড় শুরু করে দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বাড়ি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আরেক নেতা  বলেন, ‘রেজাউল করিম নিজেও ভাবতে পারেননি মনোনয়ন পাবেন তিনিই।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নাছিরবিরোধী অবস্থান রেজাউলের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। ’ তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন বোর্ডের সভায় শেখ হাসিনার অবস্থান ছিল নাছির ছাড়া প্রয়োজনে কলাগাছ মার্কা প্রার্থী দেওয়া হবে, কিন্তু তাকে নয়।

ফলে বাকশাল করা রেজাউলের ভাগ্য প্রসন্ন হয়। ’ নৌকার নতুন প্রার্থী পরিচ্ছন্ন দাবি করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওই নেতা আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে রেজাউল বিপুল ভোটে পাস করবে।

’ ভোটে তাকে মেয়রের বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে কি না জানতে চাইলে চট্টগ্রামে বাড়ি প্রভাবশালী সাবেক এক মন্ত্রীকে বলেন, আ জ ম নাছির চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এবং ভোটে জয়-পরাজয়ের ফ্যাক্টর নয়।

ক্ষমতা ও দায়িত্ব থাকলেও রাজনীতি বা কর্মী বাড়ানোর রাজনীতি করেননি তিনি।

মহানগরের রাজনীতিতে থাকতে হলে তাকে মেয়র প্রার্থীকে বিজয়ের লক্ষ্যে কাজ করতেই হবে।

বিরোধিতা করে রাজনীতি হুমকির মুখে নিশ্চয়ই ফেলবে না নাছির। দলের একাধিক নেতা দেশ কে জানিয়েছেন, রেজাউল করিম চৌধুরী একজন পোড় খাওয়া ষাট দশকের ছাত্রলীগ নেতা।

যিনি কলেজ ও জেলা ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

পরবর্তী সময়ে যুবলীগ করেছেন। যুবলীগ থেকে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

বর্তমানে একই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

রাজনীতিতে তিনি ত্যাগী হিসেবে পরিচিত। নগরে মহিউদ্দিন চৌধুরী ও নাছিরের নিজস্ব বলয় থাকলেও রেজাউলের নিজস্ব কোনো বলয় নেই।

চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে একাধিকবার মনোনয়ন চেয়েও তিনি পাননি।

তবে বর্ষীয়ান এ নেতাকে এবার দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল্যায়ন করেছেন।

আশা করা হচ্ছে, তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়ে নগরের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন। রেজাউল করিম চৌধুরীকে বলেন, ‘মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

কারণ তিনি আমাকে মূল্যায়ন করেছেন।

চসিক নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হলে চট্টগ্রামের সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগরকে ক্লিন ও গ্রিন সিটি রূপান্তরে পরিকল্পনা গ্রহণ করব।

চট্টগ্রাম শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে গড়ে তুলব।

চট্টগ্রাম নগরবাসীর দীর্ঘদিনের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে যা যা করা প্রয়োজন করব। এছাড়াও প্রয়াত নেতা চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্বপ্ন ও অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এ ক্ষেত্রে নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মী এবং নগরবাসীর কাছে ভোট ও সহযোগিতা চাই। ’দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান মেয়র নাছিরের দাবি, চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডে নানাভাবে গত সাড়ে চার বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ করেছেন।

এই উন্নয়নকে পুঁজি করে আবারও মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু ‘অদৃশ্য কারণে’ পাননি।

রেজাউল করিম চৌধুরীর মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে নেত্রীর সিদ্ধান্তকে শিরোধার্য হিসেবে নিয়েছেন বর্তমান মেয়র নাছির।

 গতকাল তিনি বলেন, ‘রেজাউল করিম চৌধুরীকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।

এ লক্ষ্যে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে আজ মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। রেজাউল ভাই বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে এসে পৌঁছবেন।

ওনাকে সাদরে বরণ করতে আমরা সার্বিক প্রস্তুতি নিচ্ছি।

’ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘রেজাউল করিম ভাই ভালো মানুষ। যোগ্য একজন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছেন নেত্রী। এর মাধ্যমে সুন্দর রাজনীতির একটা প্রতিফলন ঘটল। ’

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ‘ক্লিন ইমেজের নেতা আমাদের রেজাউল ভাই।

ওনাকে মনোনয়ন দেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।

নেতাকর্মীদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। ’

চসিক নির্বাচন সামনে রেখে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করে।

এতে বর্তমান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম, সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিনসহ ১৯ জন মেয়রপদে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন।

এর মধ্যে সবাইকে তাক লাগিয়ে শনিবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান রেজাউল করিম চৌধুরী। পরদিন রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনে চসিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. আলমগীর।

তিনি বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) আগামী ২৯ মার্চ চসিক নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল একযোগে ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়।

এতে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলমকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।

নির্বাচনে মোট ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৯ জন ভোটারের মধ্যে আ জ ম নাছির হাতি প্রতীকে পেয়েছিলেন ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এম মনজুর আলম পেয়েছিলেন কমলা লেবু প্রতীকে ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট।